ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বুধবার (২৮ মে) এক ঘোষণা জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সম্প্রতি এক বিমান হামলায় হামাসের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ সিনওয়ারকে হত্যা করেছে। খবর বার্তা সংস্থা এএফপির।
খবরে বলা হয়, ইসরায়েলি পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তব্যে নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা হাজার হাজার সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছি। আমরা (মোহাম্মদ) দেইফ, (ইসমাইল) হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনওয়ার ও মোহাম্মদ সিনওয়ারকে হত্যা করেছি।’
এই বক্তব্যের মাধ্যমে নেতানিয়াহু প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে মোহাম্মদ সিনওয়ারের মৃত্যুর কথা জানালেন। তবে তিনি হামলার সময়, স্থান বা অন্যান্য বিষয়ে বিশদ বিবরণ দেননি।
এর আগে ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানায়, গত ১৩ মে খান ইউনিস শহরের ইউরোপিয়ান হাসপাতালের নিচে অবস্থিত একটি হামাস কমান্ড সেন্টারে চালানো বিমান হামলায় মোহাম্মদ সিনওয়ার নিহত হন।
সেনাবাহিনী তখন জানিয়েছিল, সেখানে হামাসের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা অবস্থান করছিলেন। তবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে সে সময় কেউ নিহত হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করেনি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ওই হামলায় অন্তত ছয়জন নিহত এবং আরও ৪০ জন আহত হন।
সিনওয়ার পরিবারের প্রভাব ও নেটওয়ার্ক
মোহাম্মদ সিনওয়ার ছিলেন হামাসের সবচেয়ে আলোচিত নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের ছোট ভাই। বড় ভাই ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে ২০২৩ সালে ইসরায়েল একটি অভিযানে হত্যা করে বলে দাবি করেছিল। এরপরই মোহাম্মদ সিনওয়ার গাজায় হামাসের প্রধান নেতা হিসেবে দায়িত্ব নেন।
ইসরায়েলি সূত্রমতে, সিনওয়ার ভাইয়েরা খান ইউনিস শহরেরই বাসিন্দা এবং তাদের পরিবার বহু বছর ধরেই হামাসের সামরিক ও রাজনৈতিক শাখায় সক্রিয়।
ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, মোহাম্মদ ছিলেন হামাসের ‘জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ’ এর একজন সদস্য এবং তিনি সরাসরি কাসেম ব্রিগেডের কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
অতীত হামলা ও আলোচিত অপহরণ
২০০৬ সালে গাজা সীমান্তে ইসরায়েলি সেনাঘাঁটিতে হামলার পরিকল্পনায়ও জড়িত ছিলেন মোহাম্মদ সিনওয়ার। সেই হামলায় ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিত অপহৃত হন। পাঁচ বছর ধরে গোপনে আটকে রাখার পর ২০১১ সালে এক বন্দি বিনিময় চুক্তিতে এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে শালিতকে মুক্তি দেয় হামাস। সেই বিনিময় চুক্তিতে মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যেই ছিলেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার, যিনি পরে হামাসের প্রধান হন।
শরণার্থী শিবির থেকে যুদ্ধের নেতৃত্বে
মোহাম্মদ সিনওয়ার ১৯৭৫ সালে গাজার খান ইউনিস শহরের ঘনবসতিপূর্ণ শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় বিতাড়িত ফিলিস্তিনিদের একজন। হামাস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই তিনি কিশোর বয়সে দলে যোগ দেন এবং ক্রমেই সামরিক শাখার গুরুত্বপূর্ণ পদে উন্নীত হন।
গোপন জীবন, টানেলের রাজনীতি
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী একটি ভিডিও প্রকাশ করে, যেখানে গাজা টানেলের ভেতর গাড়িতে বসা এক দাড়িওয়ালা ব্যক্তিকে দেখা যায়। সেনাবাহিনী দাবি করে, সেই ব্যক্তি ছিলেন মোহাম্মদ সিনওয়ার। এটিই হতে পারে তার খুব কমসংখ্যক দৃশ্যমান প্রকাশ্য ছবির একটি। হামাস সে সময় এই দাবির সত্যতা স্বীকার করেনি।
হামলার আগে ও পরে
মোহাম্মদ সিনওয়ার ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার পরিকল্পনায়ও জড়িত ছিলেন বলে ইসরায়েলের দাবি। তাদের মতে, হামাসের কেবল হাতেগোনা কয়েকজন শীর্ষ কমান্ডার এই অভিযানের আগাম পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন এবং মোহাম্মদ সিনওয়ার তাদের একজন ছিলেন।
হামাস পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে মোহাম্মদ সিনওয়ারের মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়া হয়নি। তবে নেতানিয়াহুর মন্তব্যে বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে উঠেছে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।