বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া অবশেষে নতুন করে গতি পেতে যাচ্ছে। নিজদেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের তালিকা হালনাগাদে কাজ শুরু করেছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন। পাশাপাশি আরও দুটি ট্রানজিট সেন্টার শিগগিরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে বুঝে নেওয়ার প্রস্তুতিও চলছে।
প্রত্যাবাসন নিয়ে আশার কথা জানিয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টিটিভ। তাদের ভাষ্যমতে, আসন্ন ঈদে যেন রোহিঙ্গারা নিজ দেশে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করতে পারে, সে লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। যার মধ্যে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ৫ হাজার ৫২০ জন। পরিবার রয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ২৭৪টি। আশ্রিতদের মধ্যে ৫২ শতাংশ শিশু, ৪৪ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক এবং ৪ শতাংশ বয়স্ক রয়েছে। যার মধ্যে ৪৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৫১ শতাংশ নারী। আর প্রতিবছর ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করে।
তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৭-৭৮ সালে ২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে, যার মধ্যে ১ লাখ ৯০ হাজার মিয়ানমারে ফিরে যায়। এরপর ১৯৯১ সালে ২ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন অনুপ্রবেশ করে, যার মধ্যে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন মিয়ানমারে ফিরে যায়। ২০১২ থেকে ১৬ সাল পর্যন্ত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। তারপর ২০১৭ সালে ৮ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। আর ২০২৪ সালে ৬৪ হাজার ৭১৮ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে।
গেলো ১৪ মার্চ রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে যান জাতিসংঘের মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টা। দুজনই লাখো রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করেন। বক্তব্যে বলেন, প্রত্যাবাসন বিষয়ে আশার কথা শোনান ও আগামী রোজার ঈদে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে স্বজনদের সঙ্গে উদযাপন করতে পারবেন। এরপর জাতিসংঘের মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির সফরের মাস না পেরুতেই বাংলাদেশ থেকে প্রথম ধাপে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে মিয়ানমার। আর চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে আছে আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গা।
এদিকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠী রয়েছে ৫ লাখের কাছাকাছি। কিন্তু তার বিপরীতে রোহিঙ্গার সংখ্যা দ্বিগুণের কাছাকাছি। এতে রোহিঙ্গাদের কারণে নানামুখী সংকটে কক্সবাজারবাসী। এ অবস্থা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, দ্রুত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হলে বড় বোঝা থেকে মুক্ত হবে কক্সবাজারবাসী।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের পরিষদের সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে অনেকবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দিনশেষে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখেনি। আমরা আশা করব, ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের যে কথাটা এখন শুরু হয়েছে সেটা যাতে বাস্তবায়িত হয়। পর্যায়ক্রমে আরো যারা রোহিঙ্গা রয়েছে তাদেরকেও যাতে তাদের নিজ দেশে ফেরত নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা সরকার করে সেটা আমরা আশা করছি।
হেলাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের উপর চেপে বসেছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বা এর আগে থেকে রোহিঙ্গারা এখানে রয়েছে। রোহিঙ্গারা এখন আমাদের জন্য বিশাল এক বোঝা। তো আমরা মনে করি, সরকার থেকে এখন যেহেতু একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এটি অব্যাহত থাকলে এবং খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি বাস্তবায়িত হলে কক্সবাজারবাসী একটা বিশাল বোঝা থেকে মুক্ত হবে।
সম্প্রতি প্রথম পর্যায়ে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য শনাক্ত করেছে মিয়ানমার। তাই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ট্রানজিট সেন্টার। নতুনভাবে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দুটি ট্রানজিট সেন্টার হস্তান্তর হচ্ছে শিগগিরই। টেকনাফ ও ঘুমধুমে আগে থেকেই প্রস্তুত আছে দুটি। আর প্রত্যাবাসনের জন্য সম্মত রোহিঙ্গাদের তালিকা হালনাগাদ করার কথা বলছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য ট্রানজিট সেন্টারগুলো তৈরি আছে। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে সাম্প্রতিক সময়ে ৬ কোটি টাকা দিয়ে আরও ২টি ট্রানজিট সেন্টার নির্মাণ করেছি। ঠিকাদার আমাকে চিঠি দিয়েছে এটি হস্তান্তর করবে তারা।
কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ২০১৮ সালের তালিকা থেকে এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের অনেকেই মারা গেছেন। কেউ কেউ বিয়ে করেছেন, পরিবার ভেঙেছে এবং কারো বাচ্চা জন্ম লাভ করেছে। এটির একটি হালনাগাদের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ বাচ্চা ফেলে তো কেউ যাবে না। সেই কাজগুলো প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এগুলো করতে হবে। সেরকম একটি কাজ ২০২৩ সালের দিকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের যে পাইলট প্রজেক্টের একটা প্রকল্প ছিল সেখানে কিছু কাজ হয়েছিল। তারা ৮০০ নেয়ার কথা প্রস্তাব করল। আমরা বললাম এই ৮০০ কিন্তু ২০১৮ সালের। পরে তারা এখানে এসে সরেজমিনে দেখলো ৮০০ থেকে ১১০০ হয়েছে। তো সেরকমটি এখনও তারা যে ১ লাখ ৮০ হাজার বলছে এটি ২ লাখের ওপরে যাবে। সে কাজগুলি করতে হবে। এখন দিনক্ষণ ঠিক হলে দু’দেশ যদি বসে বিভিন্ন কমিটি আছে, কমিটি পর্যায়ে বসলে এগুলো ঠিক হবে।
মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হলেও দেশটির রাখাইন রাজ্য এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি জানান, প্রত্যাবাসন নিয়ে জটিলতা থাকলেও আগামী ঈদে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে গিয়ে যেন ঈদ উদযাপন করতে পারে সে-লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টিটিভ ড. খলিলুর রহমান বলেন, আমরা সবপক্ষের সাথে কাজ করে যাচ্ছি। যাতে আরাকানে (রাখাইন) শান্তি এবং স্থিতি অবস্থা ফিরে আসে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের একটি পরিস্থিতি বিরাজ করে। আশা করছি, আমরা সফল হবো।
ড. খলিলুর রহমান বলেন, মিয়ানমার সরকার এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে সম্মত হওয়াকে বর্তমান সরকারের বিশাল কূটনৈতিক সফলতা। এটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপটি প্রয়োজন ছিল রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য।
ড. খলিলুর রহমান আরও বলেন, আমি রোহিঙ্গাদের বলেছি একটি আন্তর্জাতিক জাতিসংঘের সম্মেলন হচ্ছে। যে সম্মেলনে রোহিঙ্গারা যেন সঙ্গবদ্ধভাবে একটি অবস্থান তুলে ধরেন। যাতে নিরাপদে স্বদেশে ফেরত যেতে পারে। আমরা সব দরজা খোলা রেখেছি সকল পক্ষের সাথে আলোচনা করছি। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা মতে আগামী ঈদে যেন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের ফিরতে পারেন সে লক্ষে কাজ করছি।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সাল থেকে নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। কিন্তু নানা ছলচাতুরির মাধ্যমে মিয়ানমার একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি।