আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে দিনরাত পরিশ্রম করে রংতুলি আর হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় প্রতিমা তৈরিতে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ব্যস্ত সময় পার করছেন সাতক্ষীরার মৃৎ শিল্পীরা।
সাতক্ষীরা জেলায় এবার ৫৯১টি পূজামণ্ডপ প্রস্তুত করা হয়েছে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে জেলায় এবার নজর কেড়েছে কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাটি পালপাড়ার পাটের তৈরি প্রতিমা। সোনালি আঁশ দিয়ে তৈরি প্রতিমাটি সেজেছে এক নান্দনিক রূপে। দুর্গা, লক্ষ্ণী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, অসুর আর মহিষাসুরসহ ১২টি প্রতিমা মোড়ানো হয়েছে পাটের আঁশ দিয়ে। প্রতিটি প্রতিমার গায়ে সোনালি ঝলক, আলোয় যেন ঝলমল করছে মণ্ডপ প্রাঙ্গণ। পাটের আঁশ ছোট ছোট টুকরা করে চিরুনি দিয়ে মসৃণ করা হয়েছে।
এরপর মাটির প্রতিমার গায়ে একে একে বসানো হয়েছে আঁশ। রঙের ব্যবহার খুবই কম হয়েছে। পাটের প্রাকৃতিক আভাই দিয়েছে সোনালি ঝলক। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন প্রতিমা দেখতে।
প্রতিমা শিল্পীসহ আয়োজকরা জানান, গত ২১ জুলাই থেকে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। ২১ দিনের টানা পরিশ্রমে শ্রমে তৈরি হয় প্রতিমাগুলো। কাঠ, বাঁশ, মাটি ও পাট দিয়ে কাঠামো তৈরি করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রমে বসানো হয়েছে আঁশের টুকরা। শুধু আঁশ বসাতেই সময় লেগেছে পাঁচ দিন। মাঝে কিছু অংশে হালকা সোনালি রং দিয়ে ঝলক বাড়ানো হয়েছে।
তারা দাবি করেন, বাংলাদেশে সোনালি আঁশ দিয়ে প্রতিমা তৈরি এটাই প্রথম। এর আগে ২০২৩ সালে একই পরিশ্রমে চিনিগুঁড়া ধান দিয়ে প্রতিমা তৈরি হয়েছিল। যা সাড়া ফেলেছিল সারা জেলায়।
পালপাড়া পূজা উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক পলাশ কুমার পাল জানান, ১৯৯৫ সাল থেকে এখানে পূজা হয়ে আসছে। কয়েক বছর ধরে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রতিমা তৈরি করা হচ্ছে। ভক্ত-দর্শনার্থীরা যেন আনন্দ পান, সেটাই আমাদের উদ্দেশ্য। তিনি জানান, এ বছর প্রতিমা তৈরিতে ৫০ কেজি পাটের আঁশ ব্যবহার করা হয়েছে। পূজার পাঁচ দিনসহ সব মিলিয়ে খরচ হবে আনুমানিক তিন লাখ টাকা। স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রবাসীরা এই ব্যয় বহন করেন। এছাড়া সরকারি সহায়তাও পাওয়া গেছে।
দর্শনার্থীরা জানান, পাট দিয়ে প্রতিমা এত সুন্দর হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সোনালি ঝলকে চোখ ঝলসে যায়। তবে খরচটা একটু বেশি হয়েছে।
দেবী দুর্গার আরাধনা আর মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে শুরু হবে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর মহাষষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে শুরু হবে উৎসব। ২ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পূজা। শাস্ত্রীয় পন্ডিতরা বলছেন, এবার দেবী দুর্গা মায়ের আগমন ঘটবে গজে (হাতিতে) এবং দেবী দুর্গা ফিরে যাবেন দোলায় চড়ে।
এদিকে, এবার জেলার ৫৯১ টি পূজামণ্ডপে যে কোন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে এবং সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিসি ক্যামেরাসহ পুলিশি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
জেলা পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দুর্গাপূজা নির্বিঘ্ন করতে জেলায় তিন স্তরের নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে সাতক্ষীরায় দুর্গাপূজা উদযাপনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে এমনটিই প্রত্যাশা সাতক্ষীরাবাসীর।
জেলা মন্দির সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিত্যনন্দ আমিন জানান, প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী দুর্গাপূজা পালন করা হবে। প্রশাসন এবার পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন বলে তারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। ইতিমধ্যে দুর্গাপূজা আয়োজনের জন্য সরকারি সাহায্যও দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে পূজামণ্ডপগুলোতে সিসি ক্যামেরা লাগানোরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এবার স্বেচ্ছাসেবকের সাথে সাথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত থাকবেন বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সাতক্ষীরার পুলিশ সপার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, কেউ যদি অপপ্রচার, গুজব বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড চালায় কিংবা পূজামণ্ডপে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
তিনি বলেন, দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণ ও সশৃঙ্খলভাবে উদ্যাপন নিশ্চিত করতে সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সহযোগিতায় শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বদা সতর্ক রয়েছে। দুর্গাপূজার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিটি পূজামণ্ডপে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের পাশাপাশি তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। দূর্গোৎসবকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কঠোর নজরদারিতে রয়েছে।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ জানান, অন্যান্য বারের মত এবারও আনন্দঘন পরিবেশে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এর কোনো ব্যত্যয় হবে না। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সেনা বাহিনী, র্যাব, বিজিবি সবাই এই উৎসবকে সফল করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। নির্দেশনা মেনে প্রতিটি ধর্মের প্রতি সম্মান দেখিয়ে উৎসব মুখর পরিবেশে এবারের পূজা উদ্যাপন করা হবে। সূত্র: বাসস