গাজা উপত্যকায় জোরালো হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অন্তত চারশো জন ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছে।
ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) দাবি করেছে, তারা হামাস নিয়ন্ত্রিত 'সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত লক্ষ্যবস্তুতে' হামলা চালাচ্ছে।
গাজার উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং হামাসের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা মাহমুদ আবু ওয়াফাহ একটি হামলায় নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
গত ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর গাজায় এটিই সবচেয়ে বড় বিমান হামলা। যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর আলোচনা সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, পবিত্র রমজান মাস হওয়ায় অনেক লোক সেহরি খাচ্ছিলেন, তথনই গাজায় বিস্ফোরণ শুরু হয়।
২০টিরও বেশি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান গাজা সিটি, রাফাহ ও খান ইউনিসের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে শুরু করে বলে তারা জানিয়েছেন।
প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যে নিহতদের মধ্যে ৫০ জনেরও বেশি শিশু এবং ২৮ জন নারী রয়েছে বলে জানা গেছে। কর্মকর্তারা সব হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ মঙ্গলবার সকালে হামলার নির্দেশ দিয়েছেন বলে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
"আমাদের জিম্মিদের মুক্তি দিতে হামাসের বারবার অস্বীকৃতি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের দূত স্টিভ উইটকফ ও মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে আসা সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের জবাবে এই হামলা," বলা হয় এতে।
"ইসরাইল এখন থেকে হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করবে।"
গাজায় হামলার পরিকল্পনা "আইডিএফ গত সপ্তাহের শেষে উপস্থাপন করেছিল এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা অনুমোদন করেছিল" বলেও জানানো হয় বিবৃতিতে।
জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন হামাসকে সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, "আমরা আমাদের শত্রুদের প্রতি কোনো দয়া দেখাব না।"
যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিলের জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে 'বিশ্বাসঘাতকতার' অভিযোগ এনে হামাস ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা বলেছে, ইসরায়েল গাজায় বন্দি অবশিষ্ট ইসরায়েলি জিম্মিদের "একটি অজানা ভাগ্যের" দিকে ঠেলে দিলো।
তবে হামাস এখনও ঘোষণা করেনি যে তারা যুদ্ধ পুনরায় শুরু করছে, পরিবর্তে মধ্যস্থতাকারীদের এবং জাতিসংঘকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছে।
হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র ফক্স নিউজকে বলেছেন, হামলা চালানোর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে ইসরায়েল পরামর্শ করেছিল।
গত পহেলা মার্চ গাজায় অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ শেষ হয়। এরপর আলোচনাকারীরা এই যুদ্ধবিরতি এগিয়ে নেওয়ার পথ খোঁজার চেষ্টা করেন।
দুই দিন আগে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দোহায় আলোচনা শুরু হয় যা ৭২ ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল। এতে মিশর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ে বাড়ানোর আলোচনা শুরু করেন বা যুদ্ধিবিরতি দ্বিতীয় পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন যা কার্যত ব্যর্থ হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পর্যায়টি এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল, যার মধ্যে হামাসের হাতে বন্দি জিম্মি এবং ইসরায়েলের হাতে বন্দি ফিলিস্তিনিদের বিনিময়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তবে আলোচনার যুক্ত একজন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, পরোক্ষ আলোচনায় উইটকফের ঠিক করে দেওয়া চুক্তির মূল বিষয়গুলো নিয়ে ইসরাইল ও হামাস একমত নয়।
ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে সর্বশেষ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। তথন হামাস ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালালে ১২০০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয়। তাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক মানুষ। ওই সময় ২৫১ জন ইসরায়েলি নাগরিককে জিম্মিও করা হয়েছিল।
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, হামাসের ওই হামলার জবাবে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে ৪৮ হাজার ৫২০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।
গাজার ২১ লাখ জনসংখ্যার বেশিরভাগই একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আনুমানিক ৭০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা, পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও আশ্রয়ের অভাব রয়েছে।
সোমবার রাতের হামলা সম্পর্কে ৩৬ বছর বয়সী মোহাম্মদ জারঘউন বলছিলেন, খান ইউনিসে তার ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির কাছে একটি তাঁবুতে ঘুমাচ্ছিলেন তারা, এসময় প্রচণ্ড বিস্ফোরণে জেগে ওঠেন।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, "আমি ভেবেছিলাম এটা দুঃস্বপ্ন! কিন্তু আমি আমার আত্মীয়দের বাড়িতে আগুন দেখেছি। ২০ জনের বেশি শহীদ ও আহত হয়েছে যাদের অধিকাংশই শিশু ও নারী।"
২৫ বছর বয়সী রমেজ আলামমারিন গাজা শহরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শিশুদের নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন।
"তারা গাজায় আবার জাহান্নামের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে," তিনি ইসরায়েল সম্পর্কে বলেন, "মৃতদেহ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মাটিতে পড়ে আছে এবং আহতরা তাদের চিকিৎসার জন্য কোনো ডাক্তার খুঁজে পাচ্ছে না।"
তিনি এএফপিকে বলেন, "তারা ওই এলাকার একটি ভবনে বোমা হামলা চালিয়েছে এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও হতাহতরা রয়েছে... চারদিকে ভয় ও আতঙ্ক। জীবনের চেয়ে মৃত্যু ভালো।"