Prof. Sirajul Islam Chowdhury of Dhaka University addressing an opinion exchange meeting on the Anti-Fascist Left Alliance at the DRU auditorium on Saturday 9 Aug 2025.
ফ্যাসিবাদের মূল উৎপাটনে ব্যাক্তি মালিকানাধীন পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বামপন্থি রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা।
শনিবার (৯ আগস্ট) সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির শফিকুল কবির মিলনায়তনে ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা আয়োজিত মতবিনিময় আলোচনায় তারা এ মন্তব্য করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তিতে সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা হয় এ আলোচনা সভায়।
‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক এ মতবিনিময় সভায় ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চার সমন্বয়ক ও গণমুক্তি ইউনিয়নের আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন আহম্মদ নাসুর সভাপতিত্বে মুখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
এ ছাড়া মতবিনিময় সভায় আলোচনা করেন গণতান্ত্রিক বাম জোটের সমন্বয়ক, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, বাসদ এর সাধারণ সম্পাদক বাম মোর্চার কেন্দ্রীয় নেতা হারুনার রশীদ ভূঁইয়া, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ, বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চ এর সভাপতি মাসুদ খান, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল কালাম, ভাসানী পরিষদ এর সাধারণ সম্পাদক ডাঃ হারুনার রশীদ, বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ও গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের সমন্বয়ক মফিজুর রহমান লাল্টু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টির কার্যকরী সভাপতি আবদুল আলী, জাতীয় গণফ্রন্টের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক রজত হুদা, নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চার কেন্দ্রীয় নেতা নাঈম উদ্দিন, ইউপিডিএফ এর কেন্দ্রীয় নেতা সুনয়ন চাকমা, প্রমুখ।
মত বিনিময় সভয় বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা মনজুর আলম মিঠু, সভা সঞ্চালনা করেন বাসদের কেন্দ্রীয় সদস্য মহিনউদ্দিন চৌধুরী লিটন।
নেতৃবৃন্দ বলেন, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশের গণতন্ত্রকামী সকল দল, ব্যক্তি, সংগঠন নিজ নিজ অবস্থান থেকে দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই-সংগ্রাম করেছে। বারবার সংগ্রামরত মানুষ নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। একদিকে শোষণ-লুটপাট, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য, ঘুষ-দুর্নীতি, অভাব এবং বেকারত্ব, অন্যদিকে দমন-পীড়ন, হত্যা-গুম, মিথ্যা মামলা, কারা নির্যাতন সবকিছু মিলে দেশের জনসাধারণ বারুদের স্তূপে পরিণত হয়েছিল। সেই বারুদের স্তূপে অগ্নিসংযোগের ভূমিকা পালন করেছিল জুলাইয়ে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন। ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করেছিল চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে। বেকারত্বের যন্ত্রণা এবং ভবিষ্যত অনিশ্চিত জীবনের শঙ্কা থেকে ছাত্র-যুবকরা ঐ আন্দোলনে দলে দলে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকার সেই আন্দোলন দমনের জন্য নির্মম পথ বেছে নেয়। পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ দিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা-নির্যাতন-গ্রেফতার করে দমনের কাজ শুরু করে। কারফিউ জারি করে আর্মি-বিজিবিকে মাঠে নামায়। বিভিন্ন বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। প্রায় এক হাজার মানুষ শহীদি আত্মদান ও প্রায় তিন হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে। দীর্ঘদিনের শোষণ-নির্যাতন, অপমান-অবমাননার শিকার সাধারণ মানুষ মরিয়া হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাধ্য হয়ে শেখ হাসিনা পরাজয় বরণ করে। কারফিউ ব্রেক করে জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে শাসকশ্রেণি এবং সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপদে শেখ হাসিনাসহ তার আত্মীয়-স্বজন ও প্রধান সহযোগীদের দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার আয়োজন করে। পালিয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিদেশি মদদদাতা এবং তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু নরেন্দ্র মোদী সরকারের আশ্রয়ে ভারতে অবস্থান নেয়। দেশীয় শাসকশ্রেণির শোষণ-লুটপাটের মদদদাতা সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোর এক অংশ ভারত কোনঠাসা হয়ে পরে। আরেক অংশ আমেরিকা তৎপর হয়ে উঠে এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের স্থান দখল করে। দেশের বুর্জোয়া শক্তি ২৪এর গণঅভ্যুত্থানসহ জনগণের কোন ন্যায্য আন্দোলনে যার কোন ভূমিকা নেই, এমন একজন মানুষ ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিশ্বস্ত বন্ধু ড. ইউনূস অধিকাংশ এনজিও এবং অবঃ সামরিক কর্মকর্তাসহ তিনজন আন্দোলনকারী ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে। ক্ষমতা গ্রহণ করে অতীতের মত করেই দেশ শাসন করতে থাকে। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য, অফিস-আদালতে ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিপীড়ন, নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা কোন কিছুই বন্ধ করতে পারেনি। বরং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মব সন্ত্রাস, নারী নিগ্রহ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন-মাজার-ভাস্কর্যসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা-ভাংচুর চলছে। উগ্র মৌলবাদী এবং স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবির বীরদর্পে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বেকারত্ব দূর করতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি দূরের কথা, গত এক বছরে কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছে কয়েক লক্ষ শ্রমিক। এখতিয়ার বহির্ভূত উদ্যোগে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের কাছে তুলে দেওয়াসহ রাখাইনে মানবিক করিডোর করতে দিয়ে দেশকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে বিদেশিদের সামরিক সরঞ্জামাদি তৈরির কারখানা করতে দিয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে। শুল্ক ছাড়ের কৌশলে গোপন শর্তে আমেরিকার সঙ্গে জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি করছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এনসিপি নামক কিংস পার্টি গঠন করে ক্ষমতা দখলে রাখার দুঃস্বপ্ন দেখছে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৩০ লক্ষ মানুষের শহীদি আত্মদান এবং দু’লক্ষ নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটেছে এই যুদ্ধে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে মুক্তিকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর ৯০ এ স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থান সংঘঠিত হয়েছে। এই অভ্যুত্থানের পরেও অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের এক বছর অতিবাহিত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এবারও অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী শাসকগোষ্ঠীর কার্যকলাপ প্রমাণ করে, সমাজের আমূল পরিবর্তনের রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বে লড়াই-সংগ্রাম পরিচালিত না হলে সংগ্রামের ফসল সংগ্রামী জনগণের ঘরে আসেনা। দেশের মানুষ অতীতে যেমন লড়াই করেছে ভবিষ্যতেও লড়াই করবে। কারণ ব্যক্তি মালিকানাধীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা জনগণের সমস্যা- সংকট নিরসন করতে পারবেনা। পুঁজিবাদের শোষণ-নিপীড়ন ছাড়া দেওয়ার আর কিছু নেই, শোষণ-নিপীড়ন বহাল রাখতে পুঁজিবাদ দেশে দেশে ফ্যাসিবাদে রূপ নিচ্ছে। ফলে বামপন্থীদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে, আগামী দিনে জনগণের যে কোন লড়াই-সংগ্রামে নেতৃত্বকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। - প্রেস বিজ্ঞপ্তি