Nazrul Islam
পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন প্রসঙ্গ
নজরুল ইসলাম
সবাইকে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা। এবার ঈদুল আজহার নামাজ টরন্টো শহর ও পার্শবর্তী শহরগুলিতে ৬ই জুন (শুক্রবার) ২০২৫ অনুষ্ঠিত হবে সবাই এক মত হয়েছে । এ দেশে ঈদের দিনে স্কুল/কলেজ বা অফিস, আদালত, কলকারখানা বন্ধ থাকে না ; কাজেই মুসলমানগণ ভোরে নামাজ পড়ে কাজে যাবে বা অনেকেই ছুটি নিয়ে নামাজ পড়ে পরিবার -পরিজন এবং বন্ধু বা পরিচিতদের সঙ্গে দেখা ও খাওয়া দাওয়া এবং আনন্দ
করবে।
এখানে আমাদের দেশের মতো কোরবানির ব্যবস্থা নেই, দোকানে গিয়ে ছাগল,ভেড়া বা গুরু কোরবানি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কেউ কেউ ফার্ম এ গিয়ে নিজেদের পছন্দ মতো কোরবানি দিয়ে থাকে। আবার অনেকে বাংলাদেশ বা আফ্রিকা আগে থেকেই টাকা পাঠিয়ে দিয়ে কোরবানির ব্যবস্থা করে।
এবার টরোন্টোর আবহাওয়া বেশ ভালো; আজ টরন্টো ২৮ ডিগ্রী তাপমাত্রা এবং আশা করা যায় আগামী কয়েকদিন ভালো আবহাওয়া থাকবে। দিনে একটু গরম,রাতে এখনো ও শীত শীত আবহাওয়া, যে জন্য রাতে শীতের আবরণ যথা ল্যাপ, কাঁথা ব্যবহার করতে হয়;এখন ও এয়ার কন্ডিশন ব্যবহার শুরু হয় নি।
আজ দীর্ঘ ৪৩ বৎসর আমি পরিবার নিয়ে বিদেশে রয়েছি। বিদেশে ঈদ বলতে সাময়িক আনন্দ; এ দেশে ছুটিছাটা পাওয়া যায় না। ছেলেমেয়েরা ঈদের দিন ও কাজ করে বা স্কুল/ কলেজে যায়।
বাংলাদেশের ঈদের আনন্দ ভিন্ন রকম ,কয়েক মাস থেকে প্রস্তুতি, তা আজ ও স্বরণ করি। সে যুগে আমরা মাবাবা,ভাইবোন,আত্মীয়স্বজন, গ্রামের বা স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে যেভাবে ঈদের আনন্দ করেছি, তা কি আর ফিরে পাবো ? সেই বয়স,সে মন– মানসিকতা সবই হারিয়ে ফেলেছি। তাছাড়া দেশে আপনজনকে রেখে, হাজার হাজার মাইল দূরে, আনন্দ উপভোগ কি সে ভাবে করা যায় ? কোরবানির ঈদে সবার সামর্থ অনুযায়ী গরু,ছাগল বা ভেড়া কেনার হিড়িক আজ ও মনে পড়ে। তাছাড়া ঈদের ছুটি, অফিস থেকে বোনাস এবং
কেনাকাটার ধুম তো মাস খানেক পূর্ব থেকেই শুরু হয়।
মনে পড়ে- ঈদের ছুটির পূর্ব থেকেই ঢাকা শহরে যানজট শুরু ; লক্ষ লক্ষ যাত্রী টিকেটের মূল্যের দ্বিগুন বা তার ও বেশি দরে দালাদের কাছ থেকে টিকেট নিয়ে,ভিড়ে বাস বা ট্রেনের ছাদে উঠার জায়গা ও পাওয়া যায় না। অপরদিকে গরুর বাজারে শেষ মুহূর্তে ভিড়,দর কষাকষি এবং দালাল তো এর মধ্যে ভূমিকা নিয়ে থাকে। তথাপি যাত্রীরা ঈদের আনন্দে মেতে উঠে এবং গ্রামে মাবাবা বা স্ত্রী ছেলেমেয়েকে নিয়ে মহা উল্লাসের প্রত্যাশা করে পকেটের সব টাকা পয়সা শেষ করে ও স্ত্রী,ছেলেমেয়ের চেহেরায় একটু আনন্দ
দেখতে চায়।
মনে পড়ে ঈদের দিন, গ্রামের পুকুরে গোছল করে নতুন কাপড় পড়ে ঘর থেকে ঈদের মাঠের জন্য পাটি,জায়নামাজ নিয়ে ঈদগাহ মাঠে, মাটিতে বিছিয়ে ছোট,বড় , গরিব, ধনী একত্রে হয়ে নামাজের জন্য অপেক্ষা করা কত আনন্দ ! চারিদিক থেকে লোকজন মাঠে জমা হচ্ছে, আলেমদের কেউ কেউ ঈদের নামাজের বর্ণনা করতেন ; এক সময় নামাজ ও খোৎবা পড়া শেষ হলে দোআ ও সব শেষে ঈদের আলিঙ্গন, সে এক অপূর্ব স্মৃতি । এই দিন গ্রামের সব মানুষের মধ্যে থাকে না কোনো ভেদাভেদ,একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরে উল্লাসে মেতে উঠে ।
নামাজ শেষ হলে গ্রামের মুরুব্বি জমিরউদ্দিন (দাদা ) দাঁড়িয়ে বলতেন “মুসল্লিগণ আপনারা সবাই আমার বাড়ির উঠানে এসে একত্রে খাওয়া দাওয়া করবেন। ” বাড়ির উঠানে পাটি,হোগলা বিছানো হতো, বসে একত্রে খাওয়া দাওয়া ও হইচই করে বাড়ি এসে দেখতাম মা-চাচিরা আজকের দিনের হরেক রকমের খাওয়া তৈরী করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। খাওয়াদাওয়া সেরে এবার গরু, ছাগল জবাই করা, মোল্লা সাহেব কার গরু আগে জবাই করবেন এই নিয়ে হতো প্রতিযোগিতা।
গত ৪৩ বৎসর নাইজেরিয়া ও কানাডায় দেশের আপনজনকে হারিয়ে নাইজেরিয়ান, ক্যানাডিয়ান ভিনদেশি মুসলমানদের সঙ্গে ঈদের উৎসব করেছি এবং এখনও করে যাচ্ছি। নাইজেরিয়াতে যে সব বাংলাদেশী বন্ধু ও তাদের পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ করেছি, তাদের অনেকেই আজ না ফেরার দেশে চলে গেছেন।
আবার কেউ কেউ আমেরিকা,অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা এবং বাংলাদেশে অবস্থান করে, কচিৎ যোগাযোগ হয়।
এই টরোন্টোতে নাইজেরিয়ান পুরানো বন্ধুদের একজন আনোয়ারুল হক দুইমাস হাসপাতালে ভোগার পর গতকাল না ফেরার দেশে চলে গেলেন। এই পবিত্র মাসে তার আত্ম্যর মাগফেরাত কামনা করি।
আমার এনায়েতপুর গ্রামের লোক যাদের সঙ্গে ছিল আত্মার আত্মীয়তার সম্পর্ক, অধিকাংশই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। সেই গ্রামের কথা স্বরণে আসলে, চোখের সামনে ভেসে উঠে অসংখ্য পরিচিত মুখ যাদের সঙ্গে ছিল আমার গভীর বন্ধন, এদের অনেকের হাত ধরে আমি ছোট সময়ে খেলাধুলা ও পড়াশুনা করেছি। এদেরই একজন আব্দুল কাদের, যাকে বড় ভাই হিসাবে শ্রদ্ধা করি, তাঁর হাত ধরেই আমার স্কুল জীবনের হাতেখড়ি, ও পড়াশুনা ও তাঁর আদর্শ অনুপ্রাণিত হয়েছি ।
এবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২.০ মিলিয়ন মুসলিম ২০২৫ সালের ৪ জুন থেকে ৯ জুনের মধ্যে মক্কা, সৌদি আরবে হজের ধর্মীয় ভ্রমণে অংশগ্রহণ করতে প্রস্তুত। গত বছর ২০২৪ সালে ১.৮৩ মিলিয়ন মানুষ হজে অংশগ্রহণ করেছিল ; এবার এই সংখ্যা গত বৎসরকে ছাড়িয়ে গেছে।
হজ্জ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে পঞ্চম স্তম্ভ।মহানবী (সঃ) বলেছেন; পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে;পঞ্চম স্তম্ভ হলো আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা।
হজ্জের তাৎপর্য নিম্নে বর্ণনা করা হলো :
১. এহরামের কাপড় গায়ে জড়িয়ে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে হজ্জের সফরে রওয়ানা হওয়া আখেরাতের পথে রওয়ানা হওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানে ধনী গরিব সব একই পোশাকে মক্কা,আরাফাত,মুজদালেফা ও মিনাতে উপস্থিত হয়ে এক আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবাদত করে। কি রাজা ,কি ধনী, কি গরিব, সবাই আজ সমান, একত্রিত হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ পালন করে।
২. সবাই এহরাম পরিধান করে এক আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিয়ে ” ‘লাব্বাইক’ আমি হাজির ” মুখে বলা ও সমস্ত গুনাহ থেকে পবিত্র হয়ে পরকালে আল্লাহর কাছে হাজিরা দেয়ার প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
৩.‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলে বান্দা আল্লাহর যে কোনো ডাকে সাড়া দেয়ার ব্যাপারে সদা প্রস্তুত থাকার কথা ঘোষণা দেয়।
৪. এহরাম অবস্থায় সকল বিধি–নিষেধ মেনে চলা – এহরাম অবস্থায় ঝগড়া করা, স্বামী– মিলন, কোনো কিছু প্রহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
৫. বায়তুল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে মুমিন নিরাপত্তা অনুভব করে-কেননা বায়তুল্লাহকে নিরাপত্তার নিদর্শন হিসেবে স্থাপন করেছেন আল্লাহ তা’আলা।
৬. হাজরে আসওয়াদ চুম্বন–স্পর্শ মুমিনের হৃদয়ে সুন্নতের তাজিম–সম্মান বিষয়ে চেতনা সৃষ্টি করে।
৭. তাওয়াফ আল্লাহ-কেন্দ্রিক জীবনের নিরন্তর সাধনাকে বুঝায়-অর্থাৎ একজন মুমিনের জীবন আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে কেন্দ্র করে ঘোরে।
৮. আল্লাহ তা’আলা নারীকে করেছেন সম্মানিতা। সাফা মারওয়ার মাঝে সাত চক্কর, আল্লাহর রহমত–মদদ কামনায় একজন নারীর সীমাহীন মেহনত, দৌড়ঝাঁপকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
৯. উকুফে আরাফা (আরাফাতের ময়দানে উপস্থিতি)কিয়ামতের ময়দানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যেখানে সমগ্র মানবজাতি একত্রিত হবে সুবিস্তৃত এক ময়দানে। যেখানে বস্ত্রহীন অবস্থায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে গুণতে হবে অপেক্ষার প্রহর।
সারা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মুসলমান আজ কী অবস্থায় রয়েছে তা আমাদের জানার বাহিরে ; গাজা (প্যালেস্টাইন ) ১.৫ মিলিয়ন মুসলমান দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে, এখানে মানবতা ব্যর্থ হচ্ছে, গাজার পরিস্থিতি এখন জাহান্নামের থেকেও খারাপ। যুদ্ধের নাম করে ইস্রায়েল গাজা উপত্যকায় আগ্রাসন ও বোমা হামলায় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে। সারা দুনিয়া থেকে ধিক্কার দিয়ে ও ইসরাইলকে গণহত্যা বন্ধ করতে পারছে না।
রাশিয়া উক্রেন যুদ্ধের কারণে হাজার হাজার লোক মৃত্যুবরণ করেছে এবং হাজার হাজার লোক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্বিসহ অবস্থায় রয়েছে।এছাড়া সিরিয়া, ইরাক,আফগানিস্তান, লিবিয়া, আরো ও অনেক দেশে যুদ্ধ হওয়ার ফলে লক্ষ লক্ষ আশ্রয়হীন মানুষ দারুন অসুবিধায় রয়েছে যাদের করুন অবস্থার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া কিছুই করার নেই । সুদান,সোমালিয়া এবং আরোও অনেক দেশে মুসলমানগণ আশ্রয়হীন, বস্ত্রহীন, খাদ্যাভাবে কষ্ট পাচ্ছে। মায়ানমারে শত শত বৎসর মুসলমান জনগণ নাগরিকত্ব বিহীন বাস করে আসছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশে এক মিলিয়নের ও অধিক মুসলমান রোহিঙ্গা করুন অবস্থার মধ্যে রয়েছে।
ইয়েমেনের শরণার্থী সংকট বিশ্বের নেতৃস্থানীয় মানবিক সংকট- ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে- সহায়তা প্রয়োজন।২০২৩ সালের সুদান সংঘাত শুরু হওয়ার পর শরণার্থী সংকট শুরু হয়-এর মধ্যে, ৫৩০,০০০ বা তার ও বেশি লোক দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, এবং ২ মিলিয়ন অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
এবার যে সব লোক হজ পালনে এখন মক্কায়, সবাই আল্লাহর ঘর তাওয়াফ শেষে আরাফাত, মুজদলাপা ও মিনাতে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের পর মক্কায় বিদায় হজ করে ঘরে ফিরবে।
দোআ করি সারা পৃথিবীর মুসলমান সুখ শান্তিতে বাস করুক- আমীন।