Nazrul Islam
নজরুল ইসলাম
নারীজাতি মানব সমাজেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিশ্ব সংসারে নারী জাতির আবির্ভাব না হলে মানব জাতির অস্তিত্ব কল্পনাও করা যেত না। তাই মহান আল্লাহ আদি পুরুষ আদমকে (আ.) সৃষ্টি করার পর সৃষ্টির পূর্ণতা আনয়নের জন্য হজরত হাওয়াকে (আ.) সৃষ্টি করেন। অতঃপর দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেন এবং উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে উদ্ভব হয় মানব সমাজের।
পবিত্র কোরআনে সূরা ‘নিসা’ ‘মহিলা’ শিরোনামে নারীর অধিকার ও কর্তব্য বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়া কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে নারীর অধিকার, মর্যাদা ও তাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। ইসলামে সর্বত্রই নারীর ন্যায্য অধিকার,জান-মালের নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো হয়েছে;নারীদের যেমনি পুরুষদের উপর, তেমনি পুরুষদের নারীদের উপর ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে ।
অন্যান্য ধর্মেও নারীদের বিশদভাবে সন্মান দেখানো হয়েছে : এখানে একটা উদাহরণ দেয়া হলো - নেপোলিয়ন বোনাপার্ট আজ থেকে আড়াই শত বৎসর পূর্বে বলেছিলেন “আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও , আমি তোমাদের একটি সভ্য, শিক্ষিত জাতির জন্মের প্রতিশ্রুতি দেব।“
জাতিসংঘ আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত পুরুষ ও মহিলাদের শিক্ষা,কাজ ও সম্মানের দিক থেকে সমান অধিকারের মাইল ফলক ধরা হয়েছ। যদিও বাস্তবে অসম্ভব বলে ধারণা করা হচ্ছে। আজকের দিনে এই অশিক্ষিত নারীর অধিকাংশই আফ্রিকা,এশিয়া ও দক্ষিন আমেরিকায় বসবাস করে। অনুন্নত দেশগুলিতে জনসংখ্যার অনুপাতে নারীশিক্ষা ব্যবস্থার অভাবের কারণে এই দারিদ্রতা মোচন সম্ভব হচ্ছে না ।
পুরুষ ও মহিলাদের অধিকারের সমতা শুধু মৌলিক মানবাধিকার নয়, বরং একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং টেকসই বিশ্বের জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তি। অন্ধকারের যুগে মহিলাদের অবহেলা করে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে নি। শিশু জন্ম নেয়ার পর প্রথম শিক্ষক মা- তার কাছ থেকেই প্রাথমিক (হাতেখড়ি ) শিক্ষা লাভ করে। কাজেই মা-ই হলো কোনো শিশুর প্রথম শক্ষিক, এই মা যদি অবহেলিত হয় -শিশু ও সমানভাবে অবহেলিত হয় -এটাই চিরন্তন সত্য। মা ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনে এবং নিজের স্বপ্নকে ছেলেমেয়েদের মাঝে দেখতে চায়।
আজকালকের জগতে একজনের রোজগারে পরিবারের খরচ চালানো কঠিন ,সে ক্ষেত্রে মা-বাবা দুইজন কাজ করলে সংসারের খরচ সহজ হয়। গত কয়েক দশকে মহিলাদের শিক্ষা ও কাজের কিছু অগ্রগতি হয়েছে, তবে ২০৩০ সালের মধ্যে লিঙ্গ সমতা অর্জনের পথে বিশ্ব যথাযথভাবে এগোচ্ছে না।
অভাবগ্রস্ত পরিবারে মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিপদজনক। ইউনেস্কোর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৩২ মিলিয়ন মেয়ে বিদ্যালয়ে যেতে পারে না ;এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মৌলিক কারণগুলো জটিল।
অনুন্নত দেশের সামাজিক কাঠামো বড়োই অবহেলিত। সামাজিক পরিবর্তনে একটি জাতি ইউ-টার্ন করতে স্বক্ষম। আমাদের ১৯৫০-১৯৬০র দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ৫-৭ টি গ্রাম মিলে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল যেখানে কোনো শিক্ষিত শিক্ষক ছিল না। গুরু ট্রেনিং প্রাপ্ত (তিন থেকে পাঁচ ক্লাস পড়ুয়া ) শিক্ষক দ্বারা পড়াশুনা করানো হতো। আজকাল প্রায় প্রতিটি গ্রামেই স্কুল দেখা যায় এবং শিক্ষার প্রতি জনগণের মনোভাব পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষার সঙ্গে একটি জাতির সাংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসে।
বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে, যে জাতি বা দেশ মেয়ে এবং নারীরা শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছে , সে জাতি দারিদ্রতা হ্রাস, উন্নত মাতৃত্ব স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক এবং সমাজকে দ্রুত এগিয়ে নিয়েছে।
সে সব দেশে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে, HIV র মতো কঠিন রোগ থেকে নিজেদের প্রতিরোধ করতে স্বক্ষম হয়েছে। আজকাল পৃথিবীতে মহিলারা পূর্বের ন্যায় পিছিয়ে নেই ; বরং শিক্ষায় এগিয়ে পুরুষদের সঙ্গে কাঁদে কাদ মিলিয়ে কাজ করে ।
আমাদের সে যুগে মেয়ে শিক্ষাকে গুরুত্ব না দিয়ে দায় হিসাবে ধরা হতো। সে যুগে ৮-১০ বৎসর হলেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ঘরের বের করে দেয়া হতো; আজকাল এ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তবে আফ্রিকার সুদান এবং আরও অনেক দেশে এখনও মেয়েদের উচ্চ শিক্ষাকে অধর্ম হিসাবে দেখে।
জাতিতত্ত্ব এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি: জনসংখ্যা তত্ত্ব নিয়ে থমাস রবার্ট মালথাস ১৭৯৮ সালে প্রস্তাব করেছিলেন যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি সর্বদা খাদ্য সরবরাহের চেয়ে বেশি হবে, যা অনিবার্য ঘাটতি এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জের দিকে নিয়ে যাবে। যদি ও এই তত্ত্ব সম্পর্কে অনেক অর্থনীতিবিদ তার বিপরীতে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন যে “শিল্প বিপ্লবের যুগে এই তত্ত্ব সঠিক নয়।“
কিন্তু অনেকেই প্রমান করেছেন যে বর্তমান বিশ্বে লোকসংখ্যা ৮ বিলিয়ন যা আর্থিক সামর্থ্যের বাইরে এবং বিশ্বের জনসংখ্যা উৎপাদনের তুলনায় অনেক বেশি। জনসংখ্যা হ্রাস করা না গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নানাহ সমস্যা নিয়ে আসবে। মেয়েদের শিক্ষা একান্তভাবে কাম্য, শিক্ষিত মহিলাদের জন্য জনসংখ্যা হ্রাস পরিকল্পনা সহজ।
স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং সুস্থতা: উন্নয়নশীল দেশে, মেয়েদের জন্য সার্বজনীন শিক্ষা এইচআইভি/এইডস সম্পর্কে জ্ঞান বাড়াতে এবং নিজেদের স্বাস্থ্যসেবার সিদ্ধান্ত নেবার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশগুলিতে লিঙ্গ বৈষম্যের প্রধান সমস্যাগুলি হল যে মহিলাদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবায় কম প্রবেশাধিকার রয়েছে, অনেক সময় তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা নেই।
আজকাল পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলিতে সম্পদের বৈষম্য মারাত্ত্বক আকার ধারণ করেছে ঐশ্বর্যশালী এবং দারিদ্রের মধ্যে ব্যবধান আকাশচুম্বী,কেউ অট্টালিকায় আবার কেউ বস্তি বা রাস্তায় ঘুমায় । কারো প্রাচুর্য্যের আধিক্য আবার কেউ অনাহারে বা অর্ধাহারে দিন কাটায় – এই যে পার্থক্য এর জন্য আমাদের দুর্নীতিপরায়ণ সমাজ দায়ী -সরকারের মধ্যে কোনোরকম জবাবদিহিতা নেই। লিঙ্গ বৈষম্যের কারণ হিসেবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো উল্লেখ করা যায়:মানবাধিকার ক্যারিয়ার,শিক্ষায় অসম প্রবেশাধিকার,কর্মসংস্থানে বৈষম্যকাজের বিভাজনআইনি সুরক্ষার অভাব,শারীরিক স্বাধীনতার অভাব,অবলম্বিত চিকিৎসা পরিষেবা,ধর্মীয় স্বাধীনতার অভাব,রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অভাব,ধর্মীয় বিষয় (ছেলেদের প্রতি অগ্রাধিকার),খারাপ মানসিকতা, অশিক্ষা যথেষ্ট ক্ষমতায়নের অভাব,পুরুষদের সাথে তুলনায় একই (এবং এমনকি বড়) কাজের জন্য অসম বেতন,দারিদ্র্য (মহিলাদেরকে নিম্ন বেতনের কাজে নিয়োগ দেয়, যা তাদের মানব পাচার এবং পতিতা ব্যবসায় জড়িত করা, আরও অনেক কারণ ও থাকতে পারে।