রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন শপিংমলসহ আবাসিক এলাকার নিরাপত্তায় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাইরে বেসরকারি কর্মীদের 'অক্সিলারি ফোর্স' হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সোমবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বা ডিএমপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পর এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, "মেট্রোপলিটন পুলিশের আইনবলে অক্সিলারি পুলিশ ফোর্স নিয়োগের ক্ষমতা আমার আছে। আমি সেই মোতাবেক অক্সিলারি পুলিশ ফোর্স হিসেবে যারা প্রাইভেট নিরাপত্তার লোকেরা আছে ওনাদেরকে নিয়োগ দিচ্ছি।"
পুলিশ জানিয়েছে, যাদেরকে এই অক্সিলারি ফোর্স হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে তাদের হাতে চিহ্নিতকারী একটি ব্যান্ড থাকবে যা দেখে বোঝা যাবে যে তারা অক্সিলারি ফোর্স।
একই সাথে এই সহায়ক পুলিশদের থাকবে নিয়মিত পুলিশ বাহিনীর মতো ক্ষমতা।
ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের ডিসি তালেবুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, "অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। নিয়োগ পাওয়ার পর তারা পুলিশের সাথে থেকেই কাজ করবে"।
একা দায়িত্ব পালন করার সময় তারা পুলিশের মতো আটক কিংবা গ্রেপ্তার করতে পারবে বলেও জানান তিনি।
ডিএমপির পক্ষ থেকে সহযোগী পুলিশ নিয়োগ দেয়ার ঘোষণার পর এই ফোর্সকে কতখানি জবাবদিহিতায় রাখা যাবে সেটি নিয়েও প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে।
আর এক্ষেত্রে ক্ষমতা বা আইনের অপব্যবহার রোধে এই ফোর্স নিয়োগে যথাযথ যাচাই বাছাইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তারা নিরপেক্ষ লোক নিবে বলে আশা করছি। তারা যেন কোনো পলিটিকাল বায়াসড লোক না নেয়"।
এর আগে বাংলাদেশ আনসার বাহিনীকে পুলিশের ক্ষমতা প্রদান করা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এমন সহযোগী নিয়োগ দেয়ার নজির নেই বলেও জানিয়েছেন সাবেক ও বর্তমান পুলিশ কর্মকর্তারা।
এ নিয়ে আরো পড়তে পারেন
পুলিশ কি পারবে মানুষের মনে তৈরি হওয়া ক্ষোভ দূর করে আস্থা ফেরাতে?
অক্সিলারি ফোর্স কি?
রোজা ও ঈদ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকার আবাসিক এলাকা ও বিভিন্ন মার্কেটে নিয়োজিত বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীরা 'অক্সিলারি (সহযোগী) পুলিশ ফোর্স' হিসেবে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার তালেবুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, "মেট্রোপলিটন পুলিশের অর্ডিন্যান্স-১৯৭৬ ধারা মোতাবেক ডিএমপি কমিশনার যদি মনে করেন, যেকোনো ব্যক্তিকে সহযোগী পুলিশ হিসেবে নিয়োগ প্রদান করতে পারেন"।
মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী এই সহযোগী পুলিশ নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, "অক্সিলারি ফোর্স বলতে বোঝায় পুরো ফোর্স না, তবে আধা সরকারি ফোর্স, পুলিশকে সহযোগিতার জন্য এ ধরনের ফোর্স ব্যবহার করার বিষয়টি পুলিশ আইনেই আছে"।
যুক্তরাজ্যে এমন বাহিনী ব্যবহারের নজির আছে উল্লেখ করে মি. হুদা বলেন, "অল্প সময়ের জন্য এই ধরনের সহযোগী ফোর্স ব্যবহার করার নজির আছে। এটা খরচও যেমন বাচায়, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকরীও"।
"আমাদের বিদ্যমান আইনে স্পেশাল পুলিশ ব্যবহার করা যায়। পুলিশ নিজের কাজের সুবিধার জন্য এটি ব্যবহার করে থাকে", যোগ করেন তিনি।
শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার জানান, এই ফোর্সের হাতে একটি ব্যান্ড থাকবে, যাতে লেখা থাকবে সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা। আইন অনুযায়ী তারা দায়িত্ব পালন ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবেন।
ডিএমপি কমিশনার মি. আলী বলেন, "পুলিশ অফিসার যেভাবে আইনগতভাবে প্রটেকশন পান, এই অক্সিলারি ফোর্সের সদস্যরাও সেই প্রটেকশন পাবেন।"
দায়িত্ব পালন শেষে এই বাহিনীকে একটি সার্টিফিকেটও প্রদান করা হবে বলেও বিবিসি বাংলাকে জানান ডিএমপির ডিসি তালেবুর রহমান।
পুলিশের সহযোগী এই বাহিনী কবে থেকে রাস্তায় নামবে সেটি এখনো নির্দিষ্ট করে জানায় নি পুলিশ। তবে এ নিয়ে কাজ শুরুর কথা জানানো হয়েছে ডিএমপির পক্ষ থেকে।
স্বাভাবিকভাবে এই অক্সিলারি বাহিনী বা সহযোগী ফোর্স কি কি করতে পারবে এ নিয়ে বিবিসি বাংলা কথা বলেছে সাবেক ও বর্তমান পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে।
এ নিয়ে ডিএমপির মিডিয়া শাখার ডিসি তালেবুর রহমান বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, পুলিশ যেমন দায়িত্ব পালন করে ঠিক একই ভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, আটক বা নিয়মিত টহলের মতো দায়িত্বগুলো পালন করতে পারবে।
তবে মি. রহমান জানান, এই অক্সিলারি বাহিনী পুলিশের মতো বেশ কিছু কাজ করতে পারলেও তারা কোনো ধরনের ইনভেস্টিগেশন বা তদন্ত পরিচালনা করতে পারবে না।
মাঠে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ আর এই বাহিনীটির কাজে কি কি পার্থক্য রয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে, পুলিশ বাহিনীর মতো প্রশিক্ষণ, দক্ষতা কিংবা দায়বদ্ধতার জায়গাগুলো থাকবে না এই 'সহযোগী ফোর্সের' কাছে।
এমন কী তাদেরকে কোন ধরনে অস্ত্র সহযোগিতা দেয়া হবে কী-না সেটি নিয়েও আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নাই বলে জানিয়েছেন ডিএমপির ডিসি মি. রহমান।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমরা প্রাথমিকভাবে চিন্তা করেছে যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে তারা পুলিশের সহযোগী ফোর্স হিসেবে কাজ করবে। পুলিশের অথরিটি তাদের আছে সেটা বোঝানোর জন্যই তাদের আর্মড ব্যান্ড দেয়া হবে"।
তবে কী পরিমাণ 'অক্সিলারি ফোর্স' প্রাথমিকভাবে নিয়োগ দেয়া হবে সেটি নিয়েও এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে ডিএমপি।
পুলিশ বাহিনীর বাইরে হঠাৎ করে নিয়োগপ্রাপ্ত লোক যখন পুলিশের ক্ষমতা পাবে সেটির ব্যবহারে কতখানি স্বচ্ছতা থাকবে এই প্রশ্নও উঠছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, "ঠিকমতো লোক যদি না নেয়া হয়, ভেরিফাইড লোক না নেয়া হয়, তাহলে এর অপব্যবহার হতে পারে। সেক্ষেত্রে ভেরিফাইড লোক নেয়া জরুরি"।
তাহলে এই সহযোগী বাহিনী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি কোন অন্যায় করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে?
এমন প্রশ্নে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মি. হুদা বলেন, "বড় অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যাবে। আর ছোটখাটো অন্যায় করলে তাকে যে কোন মুহূর্তে চাকুরিচ্যুত করা যাবে, তাতে খুব বেশি আইনকানুন মানতে হবে না"।
কেন নিয়োগ দেয়া হচ্ছে?
শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রমজান ও ঈদ উপলক্ষে অনেক রাত পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর মার্কেট, শপিংমলগুলো খোলা থাকে। তবে এই দায়িত্ব পালনে পুলিশের স্বল্পতা রয়েছে।
যে কারণে নিরাপত্তা নিশ্চিতে বেসরকারি এই নিরাপত্তা কর্মীরা মূলত 'অক্সিলারি পুলিশ ফোর্স' হিসেবে কাজ করবেন।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানিয়েছেন, রমজানে তারাবির নামাজের সময়ে ঢাকা শহরে বিভিন্ন অলিগলিতে জনশূন্যতা তৈরি হয়।
পুলিশের জনবল স্বল্পতা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমাদের লোকও অনেকে ছুটিতে যাবে, যেতে চায়। যারা ব্যারাকে থাকে, তারা দীর্ঘ সময় পরিবার ছাড়া থাকেন। তাদের একটা পারসেন্টেজকে (অংশকে) সরকারের নির্দেশে ছুটি দিতে হয়।'
কেন হঠাৎ এই অক্সিলারি ফোর্স ব্যবহার করা হচ্ছে তার একটি ব্যাখ্যাও পাওয়া গেছে শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে।
যেখানে ডিএমপি কমিশনার মি. আলী বলেন, "বিভিন্ন শপিং মল ও গেইট দিয়ে ঘেরা বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন অনুযায়ী অক্সিলিয়ারি পুলিশ ফোর্স নিয়োগের ক্ষমতা আমার আছে।
"সেই ক্ষমতা অনুযায়ী আমি বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের অক্সিলিয়ারি পুলিশ ফোর্স হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি" যোগ করেন তিনি।
পুলিশ অফিসার যেভাবে আইনগতভাবে প্রটেকশন পান, এই অক্সিলিয়ারি ফোর্সের সদস্যরাও সেই প্রটেকশন পাবেন বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার।
তিনি বলেন, 'আমি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হিসেবে আপনাদের জানাতে চাই, অনুরোধ করতে চাই, আপনারা যখন বাড়ি যাবেন, তখন আপনার বাড়ি, ফ্ল্যাট দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিজ দায়িত্বে করে যাবেন। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি"।