ফেসবুকে করা একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইল জেলার সখিপুরে একটি হিন্দু বাড়িতে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা নিয়ে একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার রাতের ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রবিবার পাল্টাপাল্টি মামলা করেছেন যার বাড়িতে হামলা হয়েছে সেই ব্যক্তি এবং স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন।
টাঙ্গাইলের সখিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাকির হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এক হিন্দু ব্যক্তির ফেসবুক আইডি থেকে একটি কমেন্টের পর ওই ব্যক্তি শনিবার রাতে থানায় জিডি করে বলেছেন যে, তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে।"
"এই ঘটনায় দুই পক্ষই মামলা করছে। আমরা ঘটনাটি খতিয়ে দেখছি" যোগ করেন তিনি।
পুলিশ জানিয়েছে, সখিপুরের বড়চনা এলাকার শংকর সাহা নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে হামলা চালায় স্থানীয় কিছু তরুণ।
হামলার ঘটনার সময়কার কিছু ভিডিও রবিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায় বাড়িটির আসবাবপত্র, টিনের বেড়া, দরজা জানালা ভাঙচুর করছে একদল ব্যক্তি। যাদের বেশিরভাগই ছিল বয়সে যুবক ও তরুণ।
বিষয়টি নিয়ে বিবিসি বাংলা কথা বলে শংকর সাহার সাথে। তিনি স্থানীয় বাজারে ব্যবসা করতেন।
মি. সাহা বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমাকে একটা চক্রান্তের ভেতর ফেলে, ধর্মীর একটা দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করছে একটি পক্ষ। আমার সাথে এলাকায় কারো কোনদিন কারো ঝগড়া বিবাদ হয়নি।"
নিজেকে তিনি বিএনপি সমর্থক দাবি করে তিনি অভিযোগ করেছেন, হামলার পেছনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা থাকতে পারে।
যদিও তার এই অভিযোগ পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন সখিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মি. হোসেন।
যেভাবে ঘটনার শুরু
শনিবার বিকেলে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে উত্তরের জেলা নীলফামারী থেকে একটি খবর লাইভ সম্প্রচার করা হয়, যাতে ওই জেলার একটি ইউনিয়নে শতবর্ষী এক বটগাছের ভেতর থেকে 'ত্রিশুলযুক্ত একটি হাত' বের হবার দাবি করা হয়।
বেসরকারি টেলিভিশনের ফেসবুক পাতায় ওই খবরের নিচে করা একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইলের এই ঘটনার সূত্রপাত।
সেখানে শংকর সাহা নামের এক ব্যক্তির ফেসবুক একাউন্ট থেকে মুসলামনদের সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগ ওঠে।
ওই কমেন্টের নিচেও কেউ কেউ মন্তব্য করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ করেন।
স্থানীয় সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম সানি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ওই কমেন্টের স্ক্রিনশট এলাকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই কিছুক্ষণের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়।
এর পরে এক পর্যায়ে মি. সাহা সখীপুর থানায় গিয়ে জিডি করে জানান যে তার ফেসবুক হ্যাক হয়েছে।
তবে, মি. সাহার ফেসবুক আইডি আসলেই হ্যাক হয়েছে কী না, তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মিছিল নিয়ে হামলা ও ভাঙচুর
পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার রাতে তারাবি নামাজের পর বড়চনা বাজারের কেন্দ্রীয় মসজিদের মুসল্লিরা বিক্ষোভ করে। এক পর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তারা স্থানীয় বাজারে আসার পর সেখানে পুলিশও উপস্থিত হয়।
ওই ঘটনার সময় ফেসবুকে কয়েকজনকে লাইভ করতেও দেখা যায়। যেখানে মি. সাহার বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাঙচুর চালাতে দেখা গেছে।
সখিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমাদের পুলিশ ছিল অল্প। ওখানে লোক ছিল এক থেকে দেড়শো। আমার ফোর্স চেষ্টা করেও পারেনি তাদের থামাতে।"
তিনি বলেন, "শুধু পুলিশ না, স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেক হামলা চালাতে নিষেধ করে বলেছিল, হামলা কোন সমাধান না, শংকরকে বলবো সে ক্ষমা চেয়ে কমেন্ট ডিলিট করে দিবে।"
"কিন্তু সিনিয়রদের এই অনুরোধ কেউ শোনেনি। বয়সে যুবক ও তরুণরাই এগিয়ে গিয়ে শ্লোগান দিয়েছে, হামলা ভাঙচুর করেছে", যোগ করেন তিনি।
মি. সাহা অভিযোগ করেছেন, তার বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের পাশাপাশি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা পয়সা লুট হয়েছে।
তিনি বলেন, "আমার ঘরবাড়ি টাকা পয়সা সব লুটপাট করেছে। পাশাপাশি আমার স্থাপনাও ভেঙে ফেলেছে। আমার স্ত্রীর গহনা ছিল, টাকা পয়সা কিছু ছিল। আরো কিছু কাগজপত্র ছিল জমির। সেগুলোও আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।"
তিনি জানান, স্কুল বন্ধ থাকায় বাচ্চাদের নিয়ে তার স্ত্রী আত্নীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। যে কারণে শারীরিকভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি।
শনিবার রাতে ওই ঘটনার পরদিন রোববার দুইপক্ষই টাঙ্গাইলের সখীপুর থানায় মামলা দায়ের করেছে বলে জানিয়েছে সখিপুর থানা পুলিশ।
পুলিশ কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বলেছেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে সবুজ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলায় শংকর সাহাকে আসামী করা হয়েছে।
এরপর বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার কথা জানিয়ে শংকর সাহার স্ত্রী শিউলি রানী বাদী হয়ে পাল্টা মামলা দায়ের করেছেন।
মি. সাহা বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এই মামলায় অজ্ঞাতনামা এক থেকে দেড়শো ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। তবে এই মামলায় কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি।"
কারা বাড়িতে হামলা বা ভাঙচুর চালিয়েছে তাদের কোন পরিচয় জানেন কী-না?
এমন প্রশ্নের উত্তরে মি. সাহা বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমি মূলত বিএনপির সাপোর্টার। কিছু আওয়ামী লীগের লোক আছে তারা আমাদের ভাল চোখে দেখে না। এটা নিয়ে আগে থেকেই তাদের মধ্যে একটা ক্ষোভ আছে। এটাকে কাজে লাগিয়েছে। তাদের কেউ কেউ হামলায় অংশ নিয়েছে।"
তবে, এই মি. সাহার এই অভিযোগকে সরাসরি নাকচ করেছে পুলিশ।
সখিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বলেছেন, মি. সাহার অভিযোগের স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ফেসবুকের পোস্ট বা কমেন্টকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার খবর অভিযোগ পাওয়া যায়।
বিশেষ করে গত অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরও এমন বেশ কয়েকটি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।
যদিও স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, "সখিপুরের এই ঘটনাটি মূলতঃ ব্যক্তি কেন্দ্রিক, কোন সম্প্রদায়ের ওপর হামলা নয়।"