এক মাস সিয়াম সাধনার পর এলো খুশির ঈদ। রোববার সন্ধ্যায় চাঁদ দেখার পরপরই রেডিও-টেলিভিশনে বেজে চলেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী সেই গান- ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ...। দেশজুড়ে চলছে উৎসবের আয়োজন।
সোমবার (৩১ মার্চ) ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর এবারই প্রথম মুক্তি পরিবেশে পালিত হতে যাচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। এবার ঈদ উৎসবে নতুন মাত্রা আনতে যাচ্ছে সরকার। সুলতানি আমলের আদলে সাজবে এবার ঈদ অনুষ্ঠান। সরকারি- বেসরকারি আয়োজনে ঈদের নামাজ শেষে বের হবে র্যালি, বসবে ঈদ মেলা, থাকবে মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এ ছাড়া, পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বাংলার ঘরে ঘরে সাধ্যমতো ভালো খাবার রান্নার চেষ্টা করা হবে। ঈদের দিন ঘুম থেকে উঠে গোসল-অজু করে দিনের শুরুতে সেমাই, মিষ্টিমুখ করে মুসল্লিরা যাত্রা শুরু করবেন ঈদের জামাতে অংশ নিতে। নামাজ আদায় শেষে ঈদগাহ ময়দানে বুকে বুক মেলাবেন।
নামাজ আদায় শেষ করে মুসল্লিরা যাবেন কবরস্থানে প্রিয়জনের বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করতে। কবরস্থান থেকে মুসল্লিরা বাসায় ফিরে খাবার খেয়ে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করবেন। প্রিয়জনের সঙ্গে আনন্দ–আড্ডায় মেতে উঠবেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। শিশুরা নতুন পোশাক পরে নিকটাত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যাবে।
এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে আপনজনের সাথে ঈদের খুশি ভাগাভাগি করে নিতে ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহর থেকে গ্রামে ফিরেছেন লাখ লাখ মানুষ। পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
এক ভিডিও বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সকলকে আনন্দময় ঈদ মোবারক জানাচ্ছি। আশা করি, ঈদের সময় আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে আপনাদের বাড়িতে যেতে পারবেন এবং আপনাদের পরিবারের সঙ্গে আনন্দের সাথে ঈদ উদ্যাপন করবেন।
দেশের জনগণকে তাদের আত্মীয়স্বজনের কবর জিয়ারত করার, দরিদ্র পরিবারের খোঁজখবর নেওয়ার এবং তাদের ভবিষ্যৎ কীভাবে উন্নত করা যায় সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনার সন্তানদের আত্মীয়স্বজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন- এটাই আমার ইচ্ছা।
এ ছাড়া, তিনি ঈদের নামাজের সময় যেকোনো মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও পরাজিত শক্তির সব উসকানির মুখে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় থাকার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ড. ইউনূস প্রার্থনা করেন, সকলের জীবন অর্থপূর্ণ ও আনন্দে ভরে উঠবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে সাহায্য করবেন।
ঈদে করণীয়:
ঈদ আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামত। কিন্তু আমরা এ দিনকে নিয়ামত হিসেবে গ্রহণ করি না। এ দিনে অনেক কাজ আছে যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হতে পারি এবং ঈদ উদযাপনও একটি ইবাদতে পরিণত হতে পারে।
ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করা:
আমাদের দেশের অনেকেই ঈদের রাতে আনন্দ করে সকালে ফজরের নামাজ আদায়ে গড়িমসি করে। অথচ ফজরের নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, যদি তারা এশা ও ফজর নামাজের মধ্যে কী আছে তা জানতে পারত তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ দু’টি নামাজের জামাতে শামিল হতো। -সহিহ বুখারি : ৬১৫
ঈদের নামাজ আদায় করা:
ঈদের দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঈদের নামাজ আদায় করা। প্রকৃতপক্ষে একজন ঈমানদার বান্দা নামাজ আদায়ের মাধ্যমে বেশি আনন্দিত হয়ে থাকে। হাদিসে এসেছে, নবী করিম সা: ঈদুল ফিতরের দিনে বের হয়ে দুই রাকাত ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। এর আগে ও পরে অন্য কোনো নামাজ আদায় করেননি। সহিহ বুখারি : ৯৮৯
ঈদের দিন গোসল করা:
ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা এ দিনে সব মানুষ নামাজ আদায়ের জন্য মিলিত হয়। ইবনে উমার (রা:) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত যে, তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার আগে গোসল করতেন। সুনান বায়হাকি : ৫৯২০
পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া:
ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া হল সুন্নত। হজরত আলী (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সুন্নত হলো ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া। -তিরমিজি : ৫৩৩। উভয় পথের লোকদেরকে সালাম দেয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য যে পথে যাবে সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে আসা। হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে, নবী করিম সা: ঈদের দিনে ফেরার পথ বিপরীত করতেন। -সহিহ বোখারি : ৯৮৬
ঈদের দিনে খাবার গ্রহণ:
ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের নামাজ আদায়ের আগে খাবার গ্রহণ করা এবং ঈদুল আজহার দিন ঈদের সালাতের আগে কিছু না খেয়ে নামাজ আদায়ের পর কোরবানির গোশত খাওয়া সুন্নত। হজরত বুরাইদা (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা: ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের সালাতের আগে খেতেন না। -তিরমিজি : ৫৪৫
ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা:
ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন- ক. হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেছেন, সাহাবারা ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, ‘তাকাববালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থ- আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। খ. ‘ঈদ মোবারক’ ইনশা আল্লাহ। গ. ‘ঈদুকুম সাঈদ’ বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।
ঈদের চাঁদ দেখার পর থেকে তাকবির পাঠ করা:
তাকবির পাঠ করার মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। তাকবির হলো-আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। লা-ইলাহা ইলাল্লাহ। আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। ওয়া লিল্লাহিল হামদ। বাক্যটি উচ্চস্বরে পড়া। আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা:) থেকে বর্ণিত, ‘হজরত রাসূলুল্লাহ সা: ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবির পাঠ করতেন। মুসতাদরাক : ১১০৬
নতুন বা পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা:
ঈদে উত্তম জামা-কাপড় পরে ঈদ উদযাপন করা। এ দিনে সব মানুষ একত্রে জমায়েত হয়, তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত হলো তার প্রতি আল্লাহর যে নিয়ামত তা প্রকাশ করণার্থে ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়স্বরূপ নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) থেকে বর্ণিত, হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, আল্লাহ রাববুল আলামিন তার বান্দার ওপর তার প্রদত্ত নিয়ামতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন। সহিহ আল জামে : ১৮৮৭। ইবনুল কায়্যিম বলেছেন, নবী করিম সা: দুই ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার আগে সর্বোত্তম পোশাক পরতেন। যাদুল মায়াদ
ঈদের খুতবা শোনা:
ঈদের খুতবা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। এতে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে। হজরত আবদুল্লাহ বিন সায়েব (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করিম সা:-এর সাথে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের নামাজ শেষ করলেন, বললেন, আমরা এখন খুতবা দেবো। যার ভালো লাগে সে যেন বসে আর যে চলে যেতে চায় সে যেতে পারে। আবু দাউদ : ১১৫৭
দোয়া ও ইস্তেগফার করা:
ঈদের দিনে আল্লাহ তায়ালা অনেক বান্দাহকে মাফ করে দেন। মুয়ারিরক আলঈজলী (রাহ.) বলেন, ঈদের এ দিনে আল্লাহ তায়ালা একদল লোককে এভাবে মাফ করে দেবেন, যেমনি তাদের মা তাদের নিষ্পাপ জন্ম দিয়েছিল। নবী করিম সা: ইরশাদ করেন, ‘তারা যেন এ দিনে মুসলিমদের জামাতে দোয়ায় অংশগ্রহণ করে।’ -লাতাইফুল মায়ারিফ
ইয়াতিম ও অভাবীকে খাবার খাওয়ানো:
ইয়াতিমের খোঁজখবর নেয়া, তাদেরকে খাবার খাওয়ানো এবং সম্ভব হলে তাদের নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেয়া। এটা ঈমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ঈদের জামাত:
রাজধানীতে পবিত্র ঈদুল ফিতরের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় ঈদগাহে সকাল সাড়ে আটটায়। এবার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পূর্বাভাস নেই। এর পরও কোনো কারণে আবহাওয়া খারাপ হলে জাতীয় ঈদগাহের পরিবর্তে সকাল নয়টায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রশাসক শাহজাহান মিয়া জানান, এবার জাতীয় ঈদগাহে একসঙ্গে ৩৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। নারীদের জন্য নামাজের আলাদা জায়গা করা হয়েছে। মুসল্লিদের জন্য অজু করার জায়গা, শৌচাগার ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। জাতীয় ঈদগাহে নামাজ আদায় করার জন্য আরামদায়ক কার্পেট বিছানো হয়েছে। তাই কাউকে জায়নামাজ সঙ্গে আনতে হবে না। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা–সহায়তার জন্য দুটি মেডিকেল টিম থাকবে।
বায়তুল মোকাররমে পাঁচটি জামাত:
বায়তুল মোকাররমে বরাবরের মতোই ঈদুল ফিতরের পাঁচটি জামাত অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম জামাত শুরু হবে সকাল ৭টায়, দ্বিতীয় জামাত আটটায়, তৃতীয় জামাত ৯টায়, চতুর্থ জামাত ১০টায় এবং শেষ জামাত হবে বেলা পৌনে ১১টায়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রথম জামাতে ইমামতি করবেন বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম হাফেজ মুফতি মাওলানা মুহিববুল্লাহিল বাকী। এ ছাড়া, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ঈদগাহ ও পাড়া–মহল্লার জামে মসজিদগুলোতে ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। আরটিভি