কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে একের পর এক ভেসে আসছে মৃত ডলফিন। গত আট বছরে অন্তত ১৩২টি ডলফিন মারা গেলেও হয়নি একটি বৈজ্ঞানিক ময়নাতদন্তও। ফলে মৃত্যুর সঠিক কারণ অন্ধকারেই রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জেলেদের অসচেতনতা, জালে আটকে শ্বাসরোধ, জাহাজের ধাক্কা কিংবা মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ সব মিলিয়েই হুমকির মুখে পড়ছে এ মূল্যবান সামুদ্রিক প্রাণী।
আগস্টেই ভেসে এসেছে চারটি ডলফিন
চলতি বছরের আগস্ট মাসেই কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে এসেছে চারটি মৃত ডলফিন। এর মধ্যে একটি ছিল বটলনোজ প্রজাতির, আর বাকি তিনটি ইরাবতী। প্রতিটির শরীরেই ক্ষতচিহ্ন ছিল।
কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির নথি অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত সৈকতে ভেসে এসেছে অন্তত ১৩২টি মৃত ডলফিন। তবু হয়নি কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
সমুদ্রের স্বাস্থ্যের সূচক ডলফিন
ডলফিনকে শুধু একটি সামুদ্রিক প্রাণী ভাবলে ভুল হবে বলে মনে করেন পরিবেশকর্মীরা। তাদের মতে, ডলফিন হলো সমুদ্রের স্বাস্থ্যের সূচক।
কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির টিম লিডার রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, ডলফিন মারা যাওয়া মানেই সমুদ্রের অসুস্থ হয়ে পড়া। মানুষ যেমন শরীরে জ্বর এলে বুঝতে পারে রোগ হয়েছে, তেমনি ডলফিনের মৃত্যু আমাদের সতর্কবার্তা দেয়। ডলফিন না থাকলে শুধু সমুদ্র নয়, আমাদের জীবিকা ও অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হবে।
তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, ‘আজ পদক্ষেপ না নিলে খুব শিগগিরই মৃত ডলফিনের সংখ্যা শত ছাড়িয়ে সহস্র হবে। তখন আর কিছু করার থাকবে না।’
জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি
উপকূল পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের (উপরা) যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল হোসেন রাজু বলেন, ‘যতদিন সমুদ্র প্রাণবৈচিত্র্যের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে থাকবে, ততদিন মানুষও প্রকৃতির আশীর্বাদ ভোগ করবে। কিন্তু ডলফিন যদি হারিয়ে যায়, তবে বুঝতে হবে সমুদ্র মরতে শুরু করেছে। ডলফিনের মৃত্যু মানে সমুদ্রের মৃত্যু, আর সমুদ্রের মৃত্যু মানে উপকূলীয় মানুষের জীবনের মৃত্যু।’
জেলেদের অভিজ্ঞতা
স্থানীয় জেলেরা জানান, ইদানিং সমুদ্রে ডলফিনের উপস্থিতি বেশি হলেও মাছ ধরার জালে আটকে তাদের মৃত্যু বাড়ছে।
বঙ্গোপসাগরের জেলে তইয়ব মাঝি বলেন, ‘আমরা জাল তুলতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই ডলফিন পাই। ওরা জালে জড়িয়ে কষ্ট পায়। কখনও আমরা কেটে ছাড়িয়ে দিই, কিন্তু অনেক সময় দেরি হয়ে যায়। তখন আর বাঁচানো যায় না।’
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার দাবি
গবেষকরা মনে করেন, ডলফিন মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ধারণে বৈজ্ঞানিক ফরেনসিক পরীক্ষা জরুরি।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাজেদুল হক বলেন, শুধু অনুমান করে মৃত্যুর কারণ বলা যাবে না। কেউ বলছেন জালে আটকে, কেউ বলছেন জাহাজের ধাক্কা, আবার কেউ বলছেন মাইক্রোপ্লাস্টিক দায়ী। কিন্তু এসবই অনুমান। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।
উপকূলীয় বন কর্মকর্তা মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সুরাতহাল রিপোর্টে বেশিরভাগ ডলফিনকে বয়স্ক পাওয়া গেছে। তবে ফরেনসিক পরীক্ষা ছাড়া মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে না। ভবিষ্যতে প্রতিটি মৃত ডলফিনের বৈজ্ঞানিক ময়নাতদন্ত নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।’
মাইক্রোপ্লাস্টিকের ভয়াবহ প্রভাব
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলীয় সমুদ্রের পানিতে শনাক্ত হয়েছে অন্তত ১৭৯ ধরনের মাইক্রোপ্লাস্টিক। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব প্লাস্টিক ডলফিনের খাদ্যনালীতে জমে গিয়ে ধীরে ধীরে প্রাণঘাতী হতে পারে। উপকূলীয় এলাকায় এর প্রভাব গভীর সমুদ্রের চেয়ে বেশি।
পরিবেশবিদরা বলছেন, কুয়াকাটায় ডলফিনের জন্য একটি নিরাপদ অভয়ারণ্য গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। তা না হলে খুব শিগগিরই ডলফিন হারিয়ে যাবে বঙ্গোপসাগর থেকে।