
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছিলেন মুক্তয়ালা রমনা, কিন্তু এতো বছরেও তার স্থায়ী কোন নিবাস হয়নি
ঢাকায় তেলুগু ভাষাভাষী পরিছন্নতা কর্মীদের একটি কলোনি খালি করে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়ায় শতাধিক পরিবার আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ওই নির্দেশে প্রতিবাদ ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন ও হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদসহ কয়েকটি সংস্থা।
ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে ওই কলোনিতে বসবাস করে আসছে তেলুগু ভাষাভাষী পরিবারগুলো। তবে এখন সেখানে সিটি কর্পোরেশন কর্মীদের জন্য আবাসন এবং ওয়ার্কশপ তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছে ডিএসসিসি।
তবে জোর করে উচ্ছেদের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বলছে, অন্যত্র থাকার জায়গা তৈরি করেই তেলুগু সম্প্রদায়ের লোকজনকে স্থানান্তর করা হবে।
ধলপুরের তেলুগু সুইপার কলোনিতে কি ঘটেছে?
ঢাকার যাত্রাবাড়ী ধলপুরের ১৪ নম্বর আউটফল তেলুগু জাত সুইপার কলোনিতে কিছুদিন আগে পুলিশ এসে নির্দেশ দেয়, ১২ই ফেব্রুয়ারির আগে তাদের এই কলোনি খালি করে দিতে হবে।
ধলপুর বস্তি নামে পরিচিত এই এলাকার আশেপাশের এলাকাগুলোও আগেই খালি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
তেলুগু কলোনির একজন বাসিন্দা ইয়ারামসেট্টি ভেঙ্কাটেশ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘’অন্যসব এলাকা যখন খালি করার কথা বলেছে, সেখানে আমাদের এই কলোনির নাম শুনিনি। কিন্তু গত আট তারিখে এসে আমাদের বলা হয়, যে আমাদেরও চলে যেতে হবে।‘’
‘’১৯৯০ সাল থেকে আমরা এখানে আছি। এখন আমরা কোথায় যাবো? আমাদের যাওয়ার কোন জায়গা নেই, নতুন করে গিয়ে ঘরবাড়ি বাড়ানোর মতোও সামর্থ্য নেই,’’ তিনি বলছেন।
ধলপুর বস্তি অথবা ডিসিসি স্টাফ কোয়ার্টার এলাকা নামে বেশিরভাগ মানুষের কাছে পরিচিত এই এলাকায় দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিশাল জায়গা এতদিন বেদখল হয়ে ছিল। সম্প্রতি সেখানে অবৈধ বাড়িঘর ও স্থাপনা ভেঙ্গে দিয়ে সিটি কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, তেলুগু জাত সুইপার কলোনির চারদিকের এলাকায় একটি মসজিদ বাদে সব স্থাপনা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে ভাঙ্গা ভবনের ইট-সুরকি সরিয়ে নেয়া কাজ করছে সিটি কর্পোরেশনের নিয়োজিত শ্রমিকরা।
এখানকার জ্যেষ্ঠ বাসিন্দা কাড়তি দেড়াম্মা বলছেন, শত বছর আগে বাসস্থান দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়েই তাদের পূর্বপুরুষদের ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ আর তেলেঙ্গানা থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল। এরপর থেকেই তারা বংশপরম্পরায় পরিছন্নতা কর্মীর কাজ করে আসছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এই সম্প্রদায়ের সদস্যরাও। পাকিস্তানি বাহিনীর বুলেটে আহত হয়েছিলেন মুক্তয়ালা রমনা।
শরীরে গুলির দাগ দেখিয়ে তিনি বলছেন, স্বাধীনতার এতো বছর পরেও এখনও তার স্থায়ী কোন নিবাস হয়নি।
কলোনির বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ১৯৯০ সালে তাদের এখানে থাকতে দেয়া হয়। সেখানে এখন ১৩০টি পরিবার বাস করছে। একটি মন্দির, দুইটি গির্জা আর একটি স্কুলও আছে। এই পরিবারগুলোর বেশিরভাগ বেসরকারি পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসাবে কাজ করে।
এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা বলছেন, সরকার বা সিটি কর্পোরেশন যদি তাদের অন্য কোথাও আবাসস্থল তৈরি করে দেয়, তাহলে তাদের যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু সেই নিশ্চয়তা তাদের কেউ দিচ্ছে না।
কিন্তু কর্পোরেশন আর পুলিশের হুমকিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে এই কলোনির ১৩০টি পরিবারের সহস্রাধিক বাসিন্দা।
বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িঘর ভেঙ্গে দেয়ার আশঙ্কায় অনেকেই খাট-জিনিসপত্র বেধে রেখেছেন। আতঙ্কিত মুখে তারা ঘোরাফেরা করছেন।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্বেগ
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন থেকে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতে বলা হয়েছে, তেলেগু সম্প্রদায়ের মাতব্বরদের ঢাকা দক্ষিণ মেয়র কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে কলোনি ছেড়ে চলে যাওয়ার মৌখিক নির্দেশ এবং যাত্রাবাড়ী থানায় ডেকে নিয়ে কলোনি ছাড়ার হুমকি দেয়ায় তারা তীব্র প্রতিবাদ, নিন্দা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
‘এ ধরনের বেআইনি উচ্ছেদ বন্ধ করাসহ ধলপুরের তেলেগু কলোনির বাসিন্দাদের সঠিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়া এই সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকার’ দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন গত রোববার এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, ‘’বিকল্প বাসস্থানের ব্যবস্থা না করে তেলেগু ভাষী সুইপার সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করা হবে বেআইনি, অগণতান্ত্রিক এবং খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত।‘’
এই কম্যুনিটির সদস্যদের সিটি কর্পোরেশনের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া এবং কোনরকম প্রতিবাদ বা মানববন্ধন না করার জন্য যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ যে নির্দেশ দিয়েছে, সেটাও গণতন্ত্র বিরোধী বলে ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে গত ১০ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ধলপুরের তেলেগু ভাষীদের কলোনি পরিদর্শন করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তারা এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
পুলিশ ও সিটি কর্পোরেশন কী বলছে
বেদখল হওয়া জায়গা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেখানে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীদের জন্য আবাসন এবং গাড়ির ওয়ার্কশপ করার পরিকল্পনা করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।
যে তেলেগু ভাষীদের কলোনি খালি করার জন্য বলা হয়েছে, ইতোমধ্যেই পাশেই বহুতল কয়েকটি ভবনে এই সম্প্রদায়ের ১২০টি পরিবারকে কোয়ার্টার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তারা সবাই সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসাবে কাজ করেন।
নয়ই ফেব্রুয়ারি এই পরিবারগুলোকে ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে গিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বলেছেন, তিনি যতদিন মেয়র থাকবেন, সিটি কর্পোরেশনের জায়গায় কোন বেদখল সহ্য করবেন না।
তিনি বলেছেন, ‘’আমাদের জমি নানাভাবে বেদখল হয়ে ছিল। দখলদার এবং বিভিন্ন গ্রুপ জমি দখল করে রেখেছিল এবং বেআইনি কর্মকাণ্ড করে লাভবান হয়েছে। যতদিন আমি এখানে থাকব, এসব আর সহ্য করা হবে না। আমাদের পরিচ্ছন্নতা কর্মী, আমাদের কর্মীরা এখানে থাকবে আর সেটা দেখভাল করা আমাদের দায়িত্ব।‘’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোঃ রাসেল সাবরিন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘’তেলেগু ভাষাভাষীদের তো জোর করে উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। সেখানে সিটি কর্পোরেশনের কর্মী যারা আছে, তাদের ফ্ল্যাট দেয়া হয়েছে। আর বাকি যারা আছে, তাদের আমরা উচ্ছেদ করবো না। তাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করে শেড তৈরি করে দেবো। থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। তারপরে তাদের সরিয়ে নেয়া হবে।‘’
তিনি ধারণা দেন, খুব তাড়াতাড়ি এটা করা হবে।
আর যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মফিজুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘’পুলিশ কাউকে কোন হুমকি দেয়নি। তেলেগু সম্প্রদায়ের বিষয়টা মেয়র মহোদয় নিজে দেখছেন। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে, এরকম কোন কাজ যেন তারা না করে।‘’
যেভাবে তেলুগু সম্প্রদায়ের লোকজন বাংলাদেশে এসেছিল
ইতিহাসবিদদের মতে, উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা এলাকা থেকে নানা ধরনের কাজের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাদের এই ভূখণ্ডে নিয়ে এসেছিল।
সেই সময় সিলেট অঞ্চলের চা বাগানের পাশাপাশি বর্ধনশীল ঢাকা ও পৌর শহরগুলোর পরিচ্ছন্নতার কাজে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। কারণ এসব কাজের জন্য তারা স্থানীয় বাঙ্গালি ভাষী কর্মী পাচ্ছিল না।
সেই সময়ে দক্ষিণ ভারতে অর্থনৈতিক সংকট থাকায় সেই এলাকার রাজ্যগুলো থেকে অনেকেই ব্রিটিশ সরকারের এসব চাকরির প্রস্তাব মেনে নেন। অনেককে নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে, প্রতিশ্রুতি দিয়ে বা অর্থের বিনিময়েও নিয়ে আসা হয়েছিল।
'আসামে ভাষা আন্দোলন ও বাঙ্গালি প্রসঙ্গ ১৯৪৭-১৯৬১' বইয়ে ইতিহাসবিদ সুকুমার বিশ্বাস লিখেছেন, ''উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আসামে শ্বেতাঙ্গ চা-করেরা যখন চা-বাগান প্রতিষ্ঠা আরম্ভ করেন, তখন স্থানীয়ভাবে শ্রমিক না পাওয়ায় তাঁরা আসাম সরকারের মাধ্যমে চা-শিল্পে কাজ করার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার শ্রমিক আনার ব্যবস্থা করেন।''
''বিহার, উড়িষ্যা (ওড়িশা), মাদ্রাজ (চেন্নাই), নাগপুর, সাঁওতাল পরগনা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ থেকে নিয়ে আসা এ সব হিন্দুস্থানি চা-শ্রমিকদের বাসস্থান ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা প্রদান করা হয়। এ জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগও চালু করা হয়। এ সময় আসাম সরকার ইমিগ্রেশন অব লেবার অ্যাক্ট চালু কার্যকর করেন। এ ভাবে কয়েক লক্ষ হিন্দুস্থানি আসামে বসবাস শুরু করেন,'' তিনি লিখেছেন।
শ্রমিকদের পাশাপাশি চা বাগান পরিচালনায় দক্ষ জনশক্তি সংগ্রহ করা হয়েছিল পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে। রেললাইন স্থাপন হওয়ায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, ত্রিপুরা- বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালিরা এসে এসব চা বাগানের বিভিন্ন পদে কাজ করতে শুরু করেন।
কিন্তু দেড়শ বছর পরেও তারা স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে গেছে।
এখনো এই সম্প্রদায়ের বিয়ে থেকে শুরু করে বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড নিজেদের মধ্যে পরিচালিত হয়। তথ্য সূত্র বিবিসি বাংলা।