News update
  • Action urgently needed to stop rise in child trafficking - UN report     |     
  • On Women’s Day, Palestinian Women Fight for Survival      |     
  • UN launches gender equality plan: ‘We’re at a turning point’     |     
  • Stock market maintain upward momentum in Dhaka, Chattogram     |     
  • Shapla Chattar Mass Killing: Arrest warrants for Hasina, 4 others     |     

‘ফলন ভালো হওয়ায় আমাদের খুশি হওয়ার কথা ছিল, অথচ এখন আহাজারি করতে হচ্ছে’

বিবিসি বাংলা খাদ্য 2025-03-12, 4:21pm

efewrewt-a15e5d47e31fe62eb502bce47be589dd1741774899.jpg




"ফলন ভালো হওয়ায় আমাদের খুশি হওয়ার কথা ছিল, অথচ তার বদলে এখন আহাজারি করতে হচ্ছে। আলু চাষ করে এমন লসের মুখে পড়ছি," আক্ষেপ করে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের আলু চাষী আহসানুর রহমান হাবিব।

বর্গা ও নিজের জমি মিলিয়ে মি. হাবিব এবছর প্রায় ৯০ বিঘা আলু চাষ করেছেন। এক্ষেত্রে প্রতিকেজি আলু চাষে অন্তত বিশ টাকা খরচ হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।

কিন্তু ফসল তোলার পর এখন তাকে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে গড়ে ১৩ টাকা দরে।

"বীজ, সার, লেবার কস্টিং মিলায়ে বিঘাপ্রতি আমার খরচ পড়েছে লাখের ওপরে। আর এখন আলু বিক্রি করে পাচ্ছি গড়ে ৬৫ হাজার। বিঘায় ৩৫ হাজার টাকা লস," বলেন মি. হাবিব।

বাম্পার ফলন হওয়ার পরও মি. হাবিবের মতো হাজারো মানুষ এবছর আলু চাষ করে লোকসানের মুখে পড়েছেন।

অথচ মাত্র কয়েক মাস আগেই বাংলাদেশের বাজারে ৮০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হতে দেখা গেছে। দাম নিয়ন্ত্রণে রীতিমত হিমসিম খাওয়ার একপর্যায়ে ভারত থেকে আলু আমদানির সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে সরকারকে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতিবছর পর্যাপ্ত উৎপাদন হওয়ার পরও সংরক্ষণের অভাবে দেশের আলুর বাজারে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে।

"এর জন্য সরকারের সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতাই প্রধানত দায়ী," বিবিসি বাংলাকে বলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

মাঠ পর্যায়ে পরিস্থিতি কেমন?

বাংলাদেশে শীর্ষ আলু উৎপাদনকারী জেলাগুলোর একটি হচ্ছে মুন্সিগঞ্জ।

অন্যান্য বছরের মতো এবারও সেখানকার বহু কৃষক আলু চাষ করেছেন, যাদের একজন শফিকুল রহমান।

"গত বছরের তুলনায় এবার ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু দাম না ওঠায় আমরা একেবারে ধরা খেয়ে গেছি," বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. রহমান।

একই কথা জানিয়েছেন মেহেরপুরের আলু চাষী সাদ্দাম হোসেন।

"কেজিপ্রতি বিশ টাকা খরচ করে আলু ফলায়ে এখন আট টাকা করে লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাহলে আমরা বাঁচবো কী করে?" বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. হোসেন।

বস্তুত গতবছর আলু চাষে ভালো লাভ পেয়েছিলেন কৃষকরা। ফলে অনেকেই এবার চালু চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। ফলনও হয়েছে ভালো।

"অন্যান্য বছর যেখানে প্রতি বিঘায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার কেজি আলু হয়, এবার সেখানে ফলন পেয়েছি প্রায় ৯০০ কেজি বেশি," বলছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের চাষী মি. হাবিব।

কিন্তু বাম্পার ফলন হলেও সেই পরিমাণ আলু সংরক্ষণের জন্য যত সংখ্যক হিমাগার প্রয়োজন, সেটা কোনো জেলাতেই নেই।

মুন্সীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, জেলাটিতে চলতি বছর আলুর উৎপাদন সাড়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর বিপরীতে সেখানকার ৫৮টি হিমাগারে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন আলু রাখা যাবে।

এ অবস্থায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় কিছুটা লোকসান মেনে নিয়েই আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষীরা।

"আমরা কী করবো? অন্যকোনো উপায় তো নেই। বিক্রি না করে ঘরে আলু রাখলে সব পঁচে নষ্ট হয়ে যাবে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন জেলাটির আরেক জন আলু চাষী মোহাম্মদ মাঈনুদ্দীন।

এদিকে, হঠাৎ চাপ বেড়ে যাওয়ায় আলু রাখার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছেন হিমাগার মালিকেরা। এতে উৎপাদকদের মধ্যে যারা আলু সংরক্ষণ করতে চাচ্ছেন, তারা আরও বেকায়দায় পড়েছেন।

"আগে যেখানে প্রতিকেজি আলু রাখতে চার থেকে পাঁচ টাকা খরচ হতো, সেটা এখন আট টাকা করে চাচ্ছে। এর কোনো যৌক্তিকতা নেই," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বগুড়ার আলু চাষী মোহাম্মদ মোতালেব।

"এখানেই শেষ না। চাপ বেড়ে যাওয়ায় তারা এখন অগ্রিম টাকাও চাচ্ছে। তাহলে আমরা কোথায় যাবো?" বলেন মি. মোতালেব।

হিমাগার মালিকরা কী বলছেন?

আলু সংরক্ষণের খরচ বৃদ্ধির জন্য হিমাগার মালিকদের দুষছেন চাষীরা। তবে মালিকরা অবশ্য দাবি করছেন যে, তারা অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়াননি।

"আমরা যে দাম চাচ্ছি সেটা মোটেও অযৌক্তিক নয়," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের একটি হিমাগারের কর্ণধার সালাম হাওলাদার।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মি. হাওলাদার বলেন, "এখন যে টাকাটা চাওয়া হচ্ছে, সেটাই আমাদের সত্যিকারের খরচ। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কথা ভেবে এতদিন আমরা নিজেরা লস দিয়ে কম টাকা নিয়েছি।"

হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও সম্প্রতি একই দাবি করা হয়।

"হিমাগারের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের খরচ দিতেই তো সাত টাকা চলে যায়," সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন সংগঠনটির সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু।

এ পরিস্থিতিতে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান হিমাগার মালিকরা।

"প্রতিবছর আমরা লস দিবো, সেটা তো হয় না। যাদের কথা ভেবে আমরা এতদিন লস দিয়েছি, তারাই তো কয়েক মাস আগে ৮০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করে মোটা টাকা আয় করেছে। তাহলে কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া দিতে অসুবিধিা কোথায়?," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য মো. আবু আব্দুল্লাহ।

তবে কৃষকদের দাবির মুখে সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি হিমাগারের ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। ঘোষিত মূল্য অনুযায়ী, এখন থেকে হিমাগারে আলু রাখতে গেছে প্রতি কেজিতে চাষীদের ছয় টাকা ৭৫ পয়সা করে গুনতে হবে।

যা বলছেন অর্থনীতিবিদরা

ভালো ফলন হওয়ার পরও আলুর সংরক্ষণ ও মূল্য নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটার জন্য সরকারকেই দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা।

"শুধু আলু না, অন্যান্য অনেক ফসলের ক্ষেত্রেও আমরা এই অবস্থা দেখি। কাজেই এটা সরকারের অজানা থাকার কথা না। তারপরও প্রতিবছরই একই ঘটনা ঘটছে, যা খুবই দুঃখজনক," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

কৃষিতে সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবেই এ ধরনের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

"দেশে বছরে আলুর চাহিদা কতটুকু এবং সেটার বিপরীতে কী পরিমাণ জমিতে আলু চাষ হচ্ছে? সেই তথ্য কী সরকারের কাছে নেই? এটা বিবেচনায় নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই তো এরকম সংকটে পড়তে হয় না," বলেন মিজ খাতুন।

বাজার স্থিতিশীল রাখাসহ সার্বিক অর্থনীতির স্বার্থে কৃষকের ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

"তা না হলে কৃষক পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ হারাবে, যার ফলে পণ্য সংকটে বাজার অস্থির হবে। সেটার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে," বলেন মিজ খাতুন।

এই সমস্যা সমাধানে সরকারি উদ্যোগেই ফসল ক্রয় ও সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সিপিডি নির্বাহী পরিচালক।

"সরকারি উদ্যোগেই এটা করতে হবে। তাহলে কৃষক যেমন ন্যায্য দাম পাবে, তেমনি বাজারে পণ্যেরও সংকট থাকবে না," বলেন মিজ খাতুন।

এছাড়া উদ্বৃত্ত পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারকে রপ্তানির পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।

সরকার কী বলছে?

বাম্পার ফলনকে কেন্দ্র করে আলু নিয়ে উৎপাদক পর্যায়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটি সমাধানে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে তা জানার জন্য কৃষি উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে বিবিসি বাংলা।

কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে খাদ্য উপদেষ্টা অবশ্য জানিয়েছেন যে, সরকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে।

"সরকার এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে, এটুকু বলতে পারি। যেহেতু বিষয়টা সরাসরি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে হচ্ছে, তারাই এটি ভালো বলতে পারবে," বিবিসি বাংলাকে বলেন খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।

এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও জানিয়েছেন যে, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।

"ইতোমধ্যেই আমরা কোল্ড স্টোরেজগুলোর ভাড়া নির্ধারণ করাসহ আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি," বিবিসি বাংলাকে বলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাসির-উদ-দৌলা।


সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে মালিকপক্ষ যেন বেশি টাকা নিতে না পারেন এবং কোনো হিমাগার যেন খালি পড়ে না থাকে, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

"কেউ এরকম কিছু করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে," বলেন ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সিরাজুল ইসলাম।

কিন্তু হিমাগারের সংখ্যা পর্যাপ্ত না হওয়ায় আলু নষ্ট হওয়ার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ কী?

"আমরা দুইভাবে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা চালাচ্ছি," বিবিসি বাংলাকে বলেন কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সোহাগ সরকার।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "ইতোমধ্যেই আমরা প্রাকৃতিকভাবে আলু সংরক্ষণের বিভিন্ন এলাকায় কিছু ঘর তৈরি করে দিচ্ছি। সেখানে অন্তত পাঁচ মাস আলু সংরক্ষণ করা যাবে।"

"এছাড়া সাধারণ কৃষকরা নিজেদের ঘরেই কীভাবে আলু সংরক্ষণ করতে পারবেন, সেই ধরনের কিছু প্রশিক্ষণ ও পরামর্শও গ্রামে গ্রামে গিয়ে দেওয়া হচ্ছে," বলেন মি. সরকার।

আলু সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগে ঘর তৈরির যে বিষয়টি এই কৃষি বিপণন কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, সরকারিভাবে সেটির কাজ শুরু হয়েছিল বছর দু'য়েক আগে।

সারা দেশে ইতোমধ্যেই এ ধরনের কয়েকশ ঘর তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

"এলাকার একজন কৃষকের জমিতেই সরকারি খরচে এটি নির্মাণ করা হয়। সেখানে ওই এলাকার অন্য কৃষকরাও আলু রাখতে পারেন," বলেন মি. সরকার।

এগুলোর বাইরে সরকারিভাবে কিছু হিমাগার নির্মাণের পরিকল্পনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দীন ফিরোজ।

"বিষয়টি নিয়ে এখনও চিন্তা চলছে। কিন্তু ততদিন চাষীরা নিজেরা কীভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে আলু সংরক্ষণ করতে পারেন, সেটি তাদের শেখানোর উদ্যোগ আমরা নিয়েছি," বলেন মি. ফিরোজ।

কোথাও কোথাও আলু রপ্তানির উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

"আমাদের এখান থেকে ইতোমধ্যে নেপাল, দুবাই এবং মালয়েশিয়ায় বেশ কয়েক টন আলু রপ্তানি করা হয়েছে," বলছিলেন ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মি. ইসলাম।

তবে যত পদক্ষেপই সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হোক না কেন, পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করা না গেলে কৃষিক্ষেত্রে সংকট পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।